জ্ঞানের আলোকায়ন হলো মানুষের নিজের উপর আরোপিত অপরিণত দশা থেকে জেগে ওঠা, আর অপরিণত দশা হলো অন্যের কর্তাগীরি ছাড়া নিজের বোধ-বুদ্ধিকে ব্যবহার করতে না-পারার অক্ষমতা। বুঝতে না-পারার অক্ষমতা নয় বরং অন্যের কর্তাগীরি ছাড়া সমস্যা সমাধানের যোগ্যাতা বা সাহসের অভাবই হলো এই অপরিণত দশা আরোপিত হওয়ার কারণ। আলোকায়নের আদর্শবানী হলঃ জানার সাহস রাখো! নিজের উপলদ্ধিকে ব্যবহার করার সাহস রাখো!
যদিও প্রকৃতি বহুকাল আগেই মানবজাতিকে অপরিচিতের দেখানো পথের খোঁজ থেকে মুক্ত করেছে, তবুও অলসতা আর কাপুরুষতাই কারণ হয়ে রইল মানবগোষ্ঠীর এক বিশাল অংশের, যেন বা সানন্দেই সে বেছে নিয়েছে জীবনের এই অপরিনত দশা। ঠিক একই কারণে কারো কারো পক্ষে নিজের হয়ে অন্যের উপর মাতব্বরির করা খুব সহজ। অপরিনত হয়ে থাকা এতই সহজ! আমার উপলদ্ধির জন্য যদি একটি বই দরকার হয়, বিবেককে জাগ্রত করার জন্য যদি একজন আধ্যাত্মিক গুরু থাকে, দৈনন্দিন খাদ্য-তালিকা বেঁধে দেয়ার জন্যে যদি ডাক্তার থাকে, তাহলে তো আমার আর কষ্ট করার প্রয়োজনই থাকে না। যতদিন আমার পারিশ্রমিক দেয়ার সামর্থ্য থাকবে ততদিন এইসব ক্লান্তিকর কাজগুলি তারাই আমার জন্য করে দেবে, আমার আর চিন্তা করার কোনো দরকার নাই। যে সকল অভিভাবকরা দয়াবান হয়ে তদারকির দায়িত্ব নিয়েছেন, তারা খুব শীগগীরই দেখতে পাবেন যে, মানবজাতির এক বিশাল অংশের পরিনত দশার দিকে এগিয়ে যাওয়া কেবল কঠিনই হবে না, অতিমাত্রায় বিপজ্জনকও হয়ে উঠবে। গৃহপালিত পশুর ভালবাসায় সিক্ত হয়ে তাদের গলায় দঁড়ি বেঁধে টেনে টেনে হাঁটিয়ে তারা বুঝিয়ে দেয় ঐ দঁড়ির সাহায্য ছাড়া হাঁটা কতটা বিপদজনক যেমনটি আমরা করে থাকি শিশুদের হাঁটতে শেখার জন্য হাঁটার গাড়ী দিয়ে। এখন এই বিপদটি আসলে ততটা বড় নয়, কয়েকবার হোঁচট খেয়ে তারা ঠিকই হাঁটতে শিখে যাবে, কিন্তু এমন উদাহরণ রীতিমত ভীতিকর এই জন্য যে, এর পরের উদ্যোগগুলো নিতে তারা সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকবে।
সুতরাং যে কোনো ব্যক্তির পক্ষে অপরিনত দশা থেকে নিজেকে মুক্ত করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, কারণ এটিই হয়ে যায় তার নিজের আরেক প্রকৃতি। এই প্রকৃতিই হয়ে যায় তার শৌখিনতা যা নিজের জ্ঞানকে ব্যবহারের পক্ষে অক্ষম করে তোলে। গোঁড়ামী আর সূত্রবিধি হলো প্রকৃতি প্রদত্ত বিবেকবুদ্ধি ব্যবহারের (বরং অপব্যবহারের) যান্ত্রিক হাতিয়ার যা এই স্থায়ী অপরিনত দশার মূল কারণ। কেউ যদি এই হাতিয়ারগুলো ছুঁড়ে ফেলেও দেয় তবুও সে-যে খুবই সরু খাদ লাফ দিয়ে পার হতে পারবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না, কারণ মুক্ত চলাচলে সে আর এখন অভ্যস্ত নয়। খুব কম মানুষই আছেন যারা মননের অনুশীলন করে অপরিনত দশা থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পেরেছেন এবং সাহসের সাথে সেই পথ ধরে অবিচ্ছিন্ন গতিতে এগিয়ে গেছেন।
পুরো জনসাধারণের এখনও সম্ভাবনা রয়েছে জ্ঞানের আলোতে আলোকিত হওয়ার। যদি সংশ্লিষ্ট জনগণকে সেই স্বাধীনতা দেয়া হয় তাহলে সত্যি সত্যি তা অনিবার্যভাবে অর্জিত হতে পারে। কারণ সব সময়ই এমন কেউ না কেউ থাকেন, এমনকি যারা জনসাধারণের কর্তা হিসাবে নিযুক্ত তারা নিজেদের নিয়ে চিন্তা করেন। এই কর্তাব্যক্তিরা যদি একবার এই অপরিণত দশার জোয়াল কাঁধ থেকে ফেলে দিতে পারেন তাহলে ব্যক্তিগত মূল্যবোধের যৌক্তিক মর্ম এবং নিজেদের জন্য চিন্তাভাবনা করার তাগিদে সবার মধ্যে দায়িত্ববোধ ছড়িয়ে দিতে পারবেন। উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হলো, এই জনসাধারণ যারা আগে অন্যের কর্তাগীরির জোয়ালে আঁটকে ছিলেন তারা ঐ কর্তাদেরই কারও কারও দ্বারা যদি আলোড়িত হন যদিও এই কর্তারা জ্ঞানের আলোতে আলোকিত হতে অক্ষম, তাহলে পরবর্তীকালে হয়তো এই কর্তারাই শুধু নিজেদের জোয়াল বাধ্য হয়ে আঁটকে থাকবেন। পুর্ব-অনুমান বা কুসংস্কার প্রচারণা অত্যন্ত ক্ষতিকারক, কারণ যারা এইসবে অন্যদের উৎসাহ যোগায় তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতিশোধের শিকার হয় (যেমন ক’রে তাদের পূর্বপুরুষরা হয়েছেন)। ফলে জনসাধারণ কেবলমাত্র ধীরে ধীরে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হতে পারে। একটি বিপ্লব কোনো স্বেচ্ছাচারী স্বৈরশাসনের এবং ক্ষমতালোভী জুলুমবাজ শাসকের দমন-পীড়নের যুগের ইতি টানতে পারে, তবে মানুষের চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে কখনোই সত্যিকারের সংস্কার বয়ে আনতে পাবে না। বরং নতুন এক কুসংস্কার পুরাতন কুসংস্কারের জায়গা দখল করে নেয়, কল্পনানির্ভর জনসাধারণকে নিয়ন্ত্রণের ক্রীড়ানক হিসাবে পরিণত করে।
জ্ঞানের আলোকায়নের জন্য মূলত যা দরকার তা হলো স্বাধীনতা। এবং এই স্বাধীনতা হলো সবচেয়ে ক্ষতিহীন – নিজস্ব বিবেকবুদ্ধির প্রকাশ্য ব্যবহারের (public use of reason) স্বাধীনতা। কিন্তু আমার চারদিকে শুনি কেবল উচ্চস্বরঃ তর্ক করো না! সেনা কর্মকর্তা বলেনঃ তর্ক করো না, কুচকাওয়াজ করো! কর-কর্মকর্তা বলেনঃ তর্ক করো না, কর দাও! ধর্মযাজক বলেনঃ তর্ক করো না, বিশ্বাস করো! (কেবলমাত্র এমন একজন শাসক আছেন যিনি বলেনঃ তর্ক করো যা নিয়ে যত খুশি, কিন্তু মেনে চলো!) এসব কিছুর মানেই হলো স্বাধীনতার নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু কোন ধরণের নিয়ন্ত্রণ জ্ঞানের আলোকায়নকে প্রতিরোধ করে, কোন ধরণের নিয়ন্ত্রণ জ্ঞানের আলোকায়নকে বাঁধাগ্রস্থ না-করে করে বরং তার নিশ্চিত করে? আমার উত্তর হলোঃ প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব বিবেকবুদ্ধির প্রকাশ্যে ব্যবহারের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে, এবং তাহলেই কেবল মানুষের মধ্যে জ্ঞানের আলোকায়ন অর্জিত হবে; কিন্তু জ্ঞানের আলোকায়নের অগ্রগতি বাঁধাপ্রাপ্ত না-করে নিজস্ব বিবেকবুদ্ধির ব্যক্তিগত ব্যবহার (private use of reason) প্রায়শই খুব সংকীর্ণ ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ হতে পারে। নিজস্ব বিবেকবুদ্ধির প্রকাশ্য ব্যবহার বলতে আমি বুঝি শিক্ষার প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত ব্যক্তির সকল পাঠকের উদ্দেশ্যে বিবেকবুদ্ধির ব্যবহার। আর বিবেকবুদ্ধির ব্যক্তিগত ব্যবহার হলো যখন কোনো ব্যক্তির কোনো সরকারী পদে বা কর্মে ন্যস্ত থাকে তখন যে বিবেকবুদ্ধির ব্যবহার প্রয়োজন হয়। এমন কিছু বিষয় আছে যা জনরাষ্ট্রের স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, সেসব ক্ষেত্রে আমাদের এমন পদ্ধতির প্রয়োজন যেখানে জনরাষ্ট্রের সদস্যদের আচরণ হবে নিষ্ক্রিয় ধরণের যেন এক কৃত্রিম সর্বজনীন চুক্তির দ্বারা তারা জনস্বার্থের অনুকূলে সরকার নির্ধারিত পথে নিয়োজিত হতে পারে (অথবা নিদেনপক্ষে তাদের অকার্যকর করা থেকে নিরস্ত থাকতে পারে)। এগুলি নিয়ে তর্ক করা নিঃসন্দেহে অনুমোদনযোগ্য নয়; আনুগত্য আবশ্যিক। যতক্ষণ পর্যন্ত কোন ব্যক্তি ঐ যন্ত্রের অংশ হিসাবে কর্মরত ততক্ষণ সে নিজেকে ঐ পূর্ণাঙ্গ জনরাষ্ট্রের একজন সদস্য হিসাবে বিবেচনা করে, বিবেচনা করে এমনকি বিশ্বজনীন (cosmopolitan) সমাজের সদস্য হিসাবে, এবং একজন বিদ্বান হিসাবে যিনি তার লেখনীর মাধ্যমে সত্যিকার অর্থে জনস্বার্থ তুলে ধরেন, তিনিই পারেন নিষ্ক্রিয় সামর্থ্যে কোনো ক্ষতিকারক কিছু না-করে নিয়োজিত দায়িত্বে থেকে কখনো কখনো যুক্তি-তর্কে অংশগ্রহণ করতে। এভাবে যদি কোনো কর্মকর্তা তার উপরপদস্থ কর্তার কাছ থেকে আদেশ পাওয়ার পর ঐ আদেশের যথাযোগ্যতা বা কার্যকারিতা নিয়ে খোলামেলা তর্কে জড়িয়ে পড়েন, তাহলে তা হবে খুবই ক্ষতিকর। তার কাজ হলো শুধু আদেশ মান্য করা। কিন্ত একজন বিদ্বান হিসাবে সামরিক পেশায় ভুল-ত্রূটি সম্পর্কে পর্যবেক্ষণমূলক বক্তব্য প্রদান থেকে এবং সুবিচারের স্বার্থে তা জনসমক্ষে তুলে ধরার চেষ্টা থেকে তাকে বিরত থাকতে বলা যথাযথ নয়। একজন নাগরিক তার উপর আরোপিত কর দিতে অস্বীকার করতে পারে না; নিজস্ব অনুমানের ভিত্তিতে এই আরোপিত করের সমালোচনা যিনি করবেন অবমাননার দায়ে তিনি এজন্য শাস্তি পেতে পারেন, কারণ তা না-হলে ব্যাপারটি গণ-অবাধ্যতার জন্ম দিতে পারে। তা সত্ত্বেও সেই একই নাগরিক একজন বিদ্বান ব্যক্তি হিসাবে যদি এই রাজস্বনীতির অবৈধতা বা এমনকি তার ন্যায়হীনতার বিরুদ্ধে নিজস্ব মতামত জনসমক্ষে তুলে ধরেন, তাহলে তিনি তার নাগরিক দায়িত্ব লঙ্ঘন করেন না। একইভাবে একজন পাদ্রী তার অনুসারীদের এবং তার ধর্মসভায় গীর্জার মতবাদ অনুযায়ী নির্দেশনা দিতে বাধ্য, কারণ তিনি ঐ শর্তের ভিত্তিতেই গীর্জায় এই কর্মে নিয়োগ পেয়েছেন। কিন্তু একজন পন্ডিত হিসাবে এই মতবাদের ভুল-ত্রূটি সম্পর্কে নিজস্ব সুচিন্তিত মতামত জনসমক্ষে তুলে ধরতে এবং ধর্মীয় ও যাজকীয় বিষয়াদির ভালো ব্যবস্থাপনা নিয়ে পরামর্শ প্রদান করতে তিনি সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং বাধ্য। এক্ষেত্রে বিবেকের দংশন কোনো বাঁধা নয়। গীর্জার একজন সক্রিয় সাধক হিসাবে তিনি তার দায়িত্ববলে যা শিক্ষা দেন তা তিনি নিজস্ব ক্ষমতাবলে ইচ্ছামাফিক করতে পারেন না, বরং তিনি যে নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসারে ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য নিযুক্ত হয়েছেন সে পদ্ধতির কথা বিবেচনায় রাখবেন। তিনি বলবেনঃ আমাদের গীর্জা এই-এই বিষয় আমাদের শিক্ষা দেয় এবং এর পিছনে এই-এই হলো যুক্তি। তারপর নিজে পুরোপুরিভাবে বিশ্বাস না-করলেও তিনি তার ধর্মসভার জন্য এমন ধর্মানুশাসন থেকে যতখানি সম্ভব ব্যবহারিক মূল্যমানের নির্যাস বের করে আনেন, কারণ একথা কেউ হলপ করে বলতে পারবে না যে তার মধ্যে সত্য নিহিত নাই। কোন অবস্থাতেই এই ধর্মীয় মতবাদের মধ্যে ধর্মের সারমর্মের বিরুদ্ধ কিছু নাই। ধর্মযাজক যদি এমন কিছু মনে করে থাকেন তবে সুস্থ বিবেকে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব তিনি পালন করতে পারেন না এবং এই দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করতে তিনি বাধ্য থাকবেন। এভাবে ধর্মসভায় ধর্মযাজক হিসাবে নিযুক্ত যে কারো বিচারবুদ্ধি ব্যবহার একান্তই ব্যক্তিগত, যেহেতু ধর্মসভা, তা যত বড়ই হোক না কেন, একটি ঘরোয়া সমাবেশের চেয়ে তেমন বড় কিছু নয়। এই দৃষ্টিকোন থেকে একজন ধর্মযাজক হিসাবে তিনি মোটেও স্বাধীন নন, স্বাধীন হতে পারেন না, কারণ তিনি বাইর থেকে তাঁর উপর আরোপিত কার্যভার পালন করছেন। বিপরীতে, একজন বিদ্বান ব্যক্তি হিসাবে প্রকৃত জনমানুষকে (অর্থাৎ সমগ্র বিশ্বকে) উদ্দেশ্য ক’রে লেখালেখির মাধ্যমে ধর্মযাজক নিজের বিচারবুদ্ধির প্রকাশ্য ব্যবহারের সূত্রে নিজস্ব বিচারবুদ্ধি ব্যবহারের এবং নিজের কথা বলার অসীম স্বাধীনতা ভোগ করেন। আধ্যাত্মিক বিষয়ে জনমানুষের অভিভাবক অপরিণত দশায় আটকে থাকবেন তা একেবারেই অযৌক্তিক, আর তা এই অযৌক্তিকতাকে চিরস্থায়ী করার শামিল।
যাজকদের সমিতি, যেমন যাজকীয় সন্মেলন অথবা শ্রদ্ধেয় প্রবীণ পুরোহিতগণের (ওলন্দাজরা যাদের বলে থাকে প্রেসবিটারী) নিজের সদস্যদের উপর চিরকালীন স্থায়ী অভিভাবকত্ব এবং তাদের মাধ্যমে পুরো জনগণের উপর অভিভাবকত্ব জাহির রাখতে কি এক প্রস্থ সংশোধন-অযোগ্য নির্দিষ্ট আদেশ-নিষেধের অঙ্গীকার করা উচিত নয়? আমার উত্তর হলো, এটা প্রায় অসম্ভব। মানবজাতিকে চিরতরে জ্ঞানের অধিকতর আলোকায়ন থেকে বিরত রাখার উপায় হিসাবে এই জাতীয় চুক্তি একেবারেই অকার্যকর, এমন কি যদি তা সর্বচ্চো ক্ষমতা, সাম্রাজ্যবাদী আইনসভা এবং সবচেয়ে পবিত্র শান্তিচুক্তি দ্বারা অনুমোদিত হয়ও। এক যুগ তার পরবর্তী যুগের কাছে আনুগত্যের অঙ্গীকারে একজোট থাকার এমন দাবী করতে পারে না যা পরবর্তী যুগের জ্ঞানের প্রসার ও সংশোধনের জন্য করণীয়, বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে, বা জ্ঞানের আলোকায়নের অগ্রগতি অর্জনের উপায়কে অসম্ভাব করে তুলতে পারে। এটা হলো মানব প্রকৃতির বিরুদ্ধে একটা অপরাধ, মানব প্রকৃতির আসল নিয়তি নিহিত এই অগ্রগতিতে। পরবর্তী প্রজন্মের পূর্ণ অধিকার রয়েছে এই জাতীয় চুক্তি খারিজ ও অবৈধ দাবী করার। বিশেষ কোন পদক্ষেপ আইন হিসাবে গৃহীত হবে কি হবে না, তা পরীক্ষা করতে চাইলে আমাদের শুধু জানতে হবে জনমানুষ নিজেদের উপর ঐ আইনটি আরোপ করতে চায় কিনা। ঐ আইন একটি সংক্ষিপ্ত সময়কালের জন্য চালু করা যেতে পারে যতক্ষণ পর্যন্ত না তার চেয়ে উৎকৃষ্ট সমাধান পাওয়া যায়। এর মানে হলো প্রত্যেক নাগরিককে, বিশেষত ধর্মযাজকদের বিদ্বান হিসাবে সর্বসমক্ষে মতামত প্রদানের স্বাধীনতা দিতে হবে, অর্থাৎ তারা যেন প্রচলিত প্রতিষ্ঠানগুলির অকার্যকারিতা নিয়ে লেখালেখি করতে পারেন। ইতোমধ্যে নতুন প্রতিষ্ঠিত শৃঙ্খলাক্রম ততক্ষণ অব্যাহত থাকবে যতক্ষণ না এই বিষয়ের প্রকৃতি নিয়ে জনমানুষের অন্তর্দৃষ্টি অগ্রগতি লাভ করে এবং ততখানি অগ্রসর হয় যখন সাধারণ সম্মতিতে (যদি সর্বসম্মতিক্রমে নাও হয়) রাজার কাছে প্রস্তাব পেশ করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, নিজেদের ধারণা অনুসারে যা উচ্চতর অন্তর্দৃষ্টি বলে বিবেচিত তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে নিজেদের ধর্মীয় প্রাতিষ্ঠানিকতা পরিবর্তনে আগ্রহীরা ধর্মসভা রক্ষা করার চেষ্টা করবে, কিন্তু যারা সবকিছু আগের মতো অপরিবর্তনীয় রাখতে চায় তাদের বাধা দেয়ার চেষ্টা করবে না। কিন্তু জনসমক্ষে প্রশ্নবিদ্ধ না-হওয়ার মতো কোন একটি স্থায়ী ধর্মীয় সংবিধান বিষয়ে, এমনকি এক জীবনে, সম্মত হওয়া একেবারেই অসম্ভব।`কারণ তা মানব জাতির উর্ধ্বমুখী অগ্রগতিকে নাকচ করে দেবে, ফল হবে বন্ধ্যাত্ব এবং পরবর্তি প্রজন্মের জন্য ক্ষতিকারক। একজন মানুষ যে-বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন কর্তব্য বোলএ মনে করে সে-বিষয়ে নিজেকে আলোকিত করা থেকে সাময়িকভাবে বিরত রাখতে পারে। কিন্তু নিজের জন্যই হোক বা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য হোক জ্ঞানের আলোকায়নকে সম্পুর্ণরূপে অস্বীকার করা মানবজাতির পবিত্র অধিকার অবমাননা এবং পদদলিত করার সামিল। কিন্তু কোন জনগোষ্ঠী যা নিজের উপর আরোপ করতে পারেনি, কোনো রাজার পক্ষে তা তাদের উপর আরোপ করার অধিকার নিতান্তই কম; কারণ তাঁর আইনগত কর্তৃত্ব নির্ভর করে তিনি জনমানুষের সম্মিলিত ইচ্ছাকে নিজে ঠিক কতখানি সংঘবদ্ধ করতে পেরেছেন। ততক্ষনই রাজা ব্যাপারটিকে এভাবে দেখেন যতক্ষণ সকল সত্য অথবা প্রকল্পিত উন্নয়নসমূহ নাগরিক শৃঙ্খলাক্রমের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা না হলে প্রজারা নিজস্ব মুক্তির জন্য যা যা করণীয় বিবেচনা করে সে বিষয়ে তাদের উপর তিনি দায়িত্ব ছেড়ে দেন – এক্ষেত্রে তাঁর আর কোনো দায়-দায়িত্ব নাই। কিন্তু তাঁর দায়িত্ব হলো কেউ যদি জোর-জবরদস্তি করে অন্যের মুক্তি বিবেচনায় ও তার উন্নয়নের চেষ্টা-কর্মে বাধা প্রদান করে তাকে প্রতিহত করা। ব্যাপারটি বরং তাঁর মহিমা খর্ব করে যদি তিনি প্রজাদের নিজস্ব ধর্মীয় ধারণা পরিশোধনের প্রচেষ্টায় লেখালেখিকে রাষ্ট্রীয় তদারকির আওতায় আনার জন্য হস্তক্ষেপ করেন। যদি তিনি নিজস্ব মতামতের মহিমায় তা করেন তাহলে তিনি নিজেকে নিজেই ভর্ৎসনার মুখামুখী করবেনঃ Caesar non est supra Grammaticos (সিজার গ্রামারিয়ান বা যিনি বিদ্বান তার চেয়ে উচ্চতর নন), আরও সত্য হলো, যদি তিনি নিজ দেশের বাকী জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু স্বেচ্ছাচারী নিপীড়কের আধ্যাত্মিক স্বৈরতন্ত্রকে সমর্থন করেন তাহলে তিনি নিজের উচ্চ কর্তৃত্বকেই খাঁটো করবেন।
যদি প্রশ্ন করা হয় যে, বর্তমানে আমরা কি জ্ঞানের আলোকিত যুগে বাস করছি, আমার উত্তর হবে, না, তবে আমরা জ্ঞানের আলোকায়নের যুগে বাস করছি। আমাদের আরো অনেক পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছাতে হবে একযোগে এমন অবস্থানে (বা একটি অবস্থানে পৌঁছে দেয়া হবে) যখন মানুষ তার উপলদ্ধিকে আত্মবিশ্বাসের সাথে ব্যবহার করতে পারবে এবং অন্যের কর্তাগীরি ছাড়াই ধর্মীয় বিষয় খুব ভালোভাবে বুঝবে। তবে আমাদের কাছে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে যে, জ্ঞানের সর্বজনীন আলোকায়নে মুক্তভাবে কাজ করার পথ এখন খোলা এবং নিজ-আরোপিত অপরিনত দশা থেকে বেরিয়ে আসার বাঁধাগুলি ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। সেই বিচারে আমাদের যুগ জ্ঞানের আলোকায়নের যুগ, রাজা ফ্রেডরিকের শতাব্দী।
যে রাজপুত্র ধর্মীয় বিষয়ে প্রজাদের কি করণীয় কি – সে বিষয়ে কিছু বলা নিজ দায়িত্ব হিসাবে বিবেচনা করে না, কিন্তু তাদের পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করে, যে রাজপুত্র এমনকি সহনশীলতার দাম্ভিক খেতাব ফিরিয়ে দেয়, সেই রাজপুত্রই আলোকিত। সেই রাজপুত্রই যিনি প্রথম মানবজাতিকে অপরিনত দশা থেকে মুক্ত করেছেন (যতখানি সরকার উদ্বিগ্ন) এবং বিবেকের বিচার্য বিষয়ে নিজ নিজ বিচারবুদ্ধি ব্যবহারে জনমানুষের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছেন, তিনি কৃতজ্ঞ জনমানুষ ও তাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। তাঁর শাসনের অধীনে ধর্মযাজকরা নিজস্ব আনুষ্ঠানিক দায়িত্বে থেকেও বিদ্বান মানুষের মত স্বাধীনভাবে এবং প্রকাশ্যে নিজেদের রায় ও মতামত সবার বিচার বিবেচনার জন্য ব্যক্ত করতে পারেন, এমনকি তা যদি গোঁড়া মতবাদের বিরুদ্ধে হয়ও। এই ব্যাপারটি পেশাগত দায়িত্বে যারা নিয়োজিত তাদের বেলায় আরো সত্য। স্বাধীনতার মর্ম বাইরের দেশেও ছড়িয়ে পড়ছে, যে দেশে সরকার তা প্রতিহত করছে সেই সরকার তার করণীয় সম্পর্কে ভুল করছে। জনমানুষের ঐক্য বা জনরাষ্ট্রের একতা বিপন্ন না করেও কিভাবে স্বাধীনতা হাজির থাকতে পারে ঐ সরকারগুলি আজ তার উজ্জ্বল নমুনা দেখতে পাচ্ছে। যদি না কেউ ঐ বর্বরতায় ধরে রাখতে ভেবে-চিন্তে কৃত্রিম বাঁধা তৈরী করে তবে মানুষ স্বেচ্ছায় তা থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসবে।
আমি জ্ঞানের আলোকায়নের কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে নিজের উপর আরোপিত অপরিনত দশা থেকে বেরিয়ে আসার প্রেক্ষিতে ধর্মীয় বিষয়গুলি বর্ণনা করেছি। প্রথমত এজন্য যে, শিল্পকলা ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে শাসকদের তাঁদের প্রজাদের উপর কর্তাগীরির ভূমিকায় হাজির হওয়ার আগ্রহ নাই, এবং দ্বিতীয়ত ধর্মীয় অপরিনত্ব সবচেয়ে বেশী অনিষ্টকারী ও আবমাননাকর। কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধানের যে-মনোভাব শিল্পকলা ও বিজ্ঞানচর্চ্চায় স্বাধীনতার পক্ষে আনুকূল্য প্রদান করে সে মনোভাবই আরো বিস্তৃত ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে, কারণ, তিনি বুঝতে পারেন যে, তিনি যদি প্রজাদের প্রকাশ্যে নিজস্ব বিবেকবুদ্ধি প্রয়োগের এবং আইন প্রণয়নে তাদের চিন্তা-ভাবনা জনসমক্ষে প্রকাশ করার সুযোগ দেন তা আইনী ব্যবস্থার জন্য ক্ষতিকর কিছু হবে না, এমনকি তা যদি বর্তমান আইনী ব্যবস্থার স্পষ্ট সমালোচনার জন্ম দেয়ও। আমাদের সামনে এমন চমৎকার উদাহরণ রয়েছে – এমন আর কোনো রাজা নাই যিনি ছাড়িয়ে গেছেন আমাদের রাজাকে, যাকে আমরা আজ শ্রদ্ধা জানাই।
কিন্তু কেবলমাত্র একজন শাসক যিনি নিজেই জ্ঞানের আলোকায়নে আলোকিত এবং যার কোন জুজুর ভয় নাই, এবং যার হাতে রয়েছে একটি সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী যারা জনতার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে, তিনিই বলতে পারেন এমন কথা যা আর কোনো প্রজাতন্ত্রীর বলার সাহস নাইঃ “তর্ক করো, যে কোন বিষয়ে যত খুশি, কিন্তু মেনে চলো”। ব্যাপারটি আমাদের সামনে মানবীয় বিষয়গুলির একটি অদ্ভুত ও অপ্রত্যাশিত ধরণ উন্মোচিত করে (যেমন আমরা যদি সেগুলি বিস্তৃত অর্থে বিবেচনা করি তাহলে মনে হবে সবই আপাতবিরোধী)। মাত্রাগতভাবে ব্যাপক নাগরিক স্বাধীনতা মানুষের বুদ্ধিগত স্বাধীনতার সহায়ক, যদিও তা অতিক্রম করে যাওয়ার পথে অসম্ভব বাঁধা সৃষ্টি করে। বিপরীতে, মাত্রাগতভাবে সীমাবদ্ধ নাগরিক স্বাধীনতা বুদ্ধিগত স্বাধীনতাকে পূর্ণমাত্রায় বিকাশের পর্যাপ্ত সুযোগ দেয়। এভাবে প্রকৃতি এক সময় মুক্তভাবে চিন্তা করার প্রবণতা ও বৃত্তির বীজ উদারভাবে মানুষের জন্যে যত্নে আগলে রেখেছে, সেই বীজ আজ শক্ত খোলসের ভিতরে পরিণত হয়েছে, স্বক্রিয় হয়েছে জনমানুষের মানসিকতার উপর, আর এই জনমানুষ ধীরে ধীরে তার কর্মে স্বাধীন হয়ে উঠছে। শেষমেশ তা এমনকি সরকারী নীতিমালার উপর প্রভাব ফেলছে, যে নীতিগুলি মানুষকে যন্ত্রের চাইতেও বড় কিছুর মর্যাদা যথাযথভাবে দিয়ে নিজেই আরো সম্বৃদ্ধ হয়ে উঠছে।
কোনিসবার্গ, প্রূশিয়া, ৩০ সেপ্টেম্বর, ১৭৮৪ (Immanuel Kant. Practical Philosophy, বই থেকে সংগৃহীত। কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত, ১৯৯৬। সম্পাদনা ও ইংরাজী অনুবাদ করেছেন ম্যারী জে. গ্রেগর।)