প্রযুক্তিগত পুনরুৎপাদনযোগ্যতার যুগে শিল্পকলার ভূমিকা (পর্ব ৩) / ওয়াল্টার বেনিয়ামিন

২.
এমনকি সবচেয়ে নিখুঁত পুনরুৎপাদনেও একটি জিনিসের অভাব পরিলক্ষিত হয়ঃ শিল্পকর্ম সৃষ্টির সেই সময় এবং স্থান – কোনো নির্দিষ্ট স্থানে তার অস্তিত্বের অনন্যতা। এই অনন্য অস্তিত্বই, অন্য আর কিছুই নয়, যা শিল্পকর্মের প্রাসঙ্গিকতার ঐতিহাসিক নিদর্শন। এই ইতিহাস তার মালিকানার পরিবর্তনসহ সময়ের সাথে সাথে শিল্পকর্মের শারীরিক গঠনে পরিবর্তনগুলি ধরে রাখে৩। শারীরিক গঠনে পরিবর্তনগুলির চিহ্নগুলি কেবল রাসায়নিক বা শারীরিক বিশ্লেষণে (যা পুনরুৎপাদিত কর্মের উপর করা সম্ভব নয়) সনাক্ত করা যায়, আর মালিকানার পরিবর্তনগুলি একটি ঐতিহ্যের অংশ যাকে কেবলমাত্র তার বর্তমান অবস্থান থেকে মৌলিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে চিহ্নিত করা সম্ভব।

শিল্পকর্মের মৌলিকতায়ে ক্ষেত্রে তার সৃষ্টির সময় এবং স্থান তার নির্ভেজালত্বের ধারণাকে ধরে রাখে। রাসায়নিক বিশ্লেষণ যেমন ব্রোঞ্জের প্যাটিনার নির্ভেজালত্ব প্রমাণে সহায়ক, ঠিক তেমনি মধ্যযুগের কোনো পাণ্ডুলিপি পঞ্চদশ শতাব্দীর সংরক্ষণাগার থেকে সংগৃহীত কিনা তা প্রমাণ করা সম্ভব। নির্ভেজালত্বের পুরো ব্যাপারটি কেবল প্রযুক্তিগত-পুনরুৎপাদনযোগ্যতা নয়, প্রযুক্তির নাগালের বাইরে ৪। হাতে-পায়ে যে পুনরুৎপাদন তার মাঝে নির্ভেজালত্বের মর্যাদা বিরাজ করে যদিও তাকে জালিয়াতি হিসাবে মূল্যায়িত করা হয়, প্রযুক্তিগত পুনরুৎপাদনের ক্ষেত্রে তা করা হয় না। এর কারণ দুটিঃ প্রথমত, মৌলিক শিল্পকর্মের প্রযুক্তিগত পুনরুৎপাদন হাতে-পায়ের পুনরুৎপাদনের চেয়ে অনেক বেশী স্বতন্ত্র। উদাহরণস্বরূপ, ফটোগ্রাফি মৌলিকতার যে দিকগুলি স্পষ্ট করতে পারে তা কেবল লেন্সের মধ্য দিয়ে সহজগম্য (যা সমন্বয় করা এবং সহজেই দৃষ্টিকোন পরিবর্তন করে করা সম্ভব) কিন্তু মানুষের দিব্যদৃষ্টি দিয়ে নয়; অথবা তা এমন কিছু প্রক্রিয়া ব্যবহারের মাধ্যমে চিত্রগুলি রেকর্ড করে, যেমন আকারে বড় করা (enlargement) বা ধীর গতি-সম্পন্ন (slow motion) করা, যা প্রাকৃতিক আলোকবিজ্ঞানের পুরাপুরি এড়িয়ে যায়। এটাই প্রথম কারণ। দ্বিতীয়ত, প্রযুক্তিগত পুনরুৎপাদন আসলের এমন অনুলিপি তৈরী করতে পারে যা ঐ আসল শিল্পকর্ম নিজেই অর্জন করতে পারে না। সর্বোপরি, হোক সে ফটোগ্রাফ বা গ্রামোফোন রেকর্ড এই পুনরুৎপাদন গ্রহীতাকে আসলের আধাআধি স্বাধ দিয়ে দেয়। শিল্পকলার গুণগ্রাহীর স্টুডিওতে ক্যাথেড্রাল আর সত্যিকারের ক্যাথেড্রাল এক নয় তার বস্তুগত অবস্থানের কারণেই; মিলনায়তনে বা খোলা আকাশে ঐক্যতানিক গান (choral work) এখন ঘরে বসেই উপভোগ করা যায়।

প্রযুক্তিগতভাবে পুনরুৎপাদিত শিল্পপণ্য শিল্পকর্মের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলি অপরিবর্তিত রাখে, কিন্তু শিল্পকর্ম সৃষ্টির সেই সময় এবং স্থান – এই দুই বৈশিষ্টকে অবমূল্যায়িত করে। যদিও ব্যাপারটি কেবল চিত্রকলায় নয়, চলচ্চিত্রে (যেমন ধরুন) একজন দর্শকের চোখের সামনে প্রাকৃতিক দৃশ্য খুব দ্রুত সরে যাচ্ছে – এক্ষেত্রেও ঘটে, চিত্রকলায় এই প্রক্রিয়াটি ব্যাপকভাবে সংবেদনশীলতার মূল স্পর্শ করে যা তাকে প্রাকৃতিক বস্তুর চেয়ে বেশি অরক্ষিত করে তোলে। সংবেদনশীলতার এই মূলই হলো তার নির্ভেজালত্ব। কোনো কিছুর নির্ভেজালত্ব হলো তার সাথে সম্পর্কিত বস্তুগত সময়কাল থেকে শুরু করে ঐতিহাসিক সাক্ষ্য পর্যন্ত যা কিছু তা তার উৎস থেকে তারই মধ্যে প্রেরিত হয় – এটাই তার বিশুদ্ধ সার। যেহেতু ঐতিহাসিক সাক্ষ্য বস্তুগত সময়কালের ভিত্তি, পুনরুৎপাদনে ঐতিহাসিক সাক্ষ্যও বিপন্ন হয় যেখানে বস্তুগত সময়কালের আর কোনো ভূমিকা থাকে না। এবং যখন ঐতিহাসিক সাক্ষ্য আক্রান্ত হয় তখন যা সত্যি সত্যি বিপন্ন হয় তা হলো বস্তুর কর্তৃত্ব৫।

কেউ হয়ত জ্যোতির ধারণার (concept of the aura) ভিতরে এড়িয়ে যাওয়া উপাদানকে আঁকড়ে ধরে বলতে পারেনঃ প্রযুক্তিগত পুনরুৎপাদনযোগ্যতার যুগে চিত্রকলায় যা শুকিয়ে যায় তা হলো চিত্রকলার জ্যোতি (aura)। এই প্রক্রিয়া একটি লক্ষণ বিশেষ; এর তাৎপর্য শিল্প জগতের বাইরেও প্রসারিত হয়। বলা যেতে পারে, পুনরুৎপাদন প্রযুক্তি পুনরুৎপাদিত বস্তুকে তার ঐতিহ্যের জগত থেকে আলাদা করে দেয়। শিল্পকর্মের শত শত প্রতিলিপি করে, পুনরুৎপাদন শিল্পকর্মের অনন্য অস্তিত্বকে তার গণ-অস্তিত্ব দিয়ে প্রতিস্থাপিত করে। এবং পুনরুৎপাদনকে গ্রহীতার নিজস্ব পরিমন্ডলে মেনে নিলে পুনরুৎপাদিত শিল্পকর্মটি বাস্তবে পরিণত হয়। এই দুই প্রক্রিয়া অতীতের সকল বস্তুর এক্তিয়ারে ব্যাপক বিপর্যয় ঘটায় – ঐতিহ্যের এই বিপর্যয় বর্তমান সংকট এবং পুনর্মানবিকীকরনের উল্টা দিক। উভয় প্রক্রিয়া একালের গণআন্দোলনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। এর সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিনিধি হলো চলচ্চিত্র শিল্প। চলচ্চিত্রের সামাজিক তাৎপর্য এমনকি, বিশেষভাবে সর্বাধিক ইতিবাচক অর্থে এর ধ্বংসাত্মক, আবেগমুক্তির দিকটি ছাড়াই কল্পনা করা যায় নাঃ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারে ঐতিহ্যের মূল্যের দেউলিয়াকরণ। এই ব্যাপারটি সবচেয়ে স্পষ্ট ইতিহাস-ভিত্তিক চলচ্চিত্রে। এটি এর প্রসারে আরও উন্নত অবস্থানগুলিকে একীভূত করছে। ১৯২৭ সালে আবেল গ্যান্স যখন দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করেছিলেন, “শেক্সপিয়ার, রেমব্র্যাঁ, বিটোভেন চলচ্চিত্র নির্মান করবেন …… সকল কিংবদন্তি, সকল পৌরাণিক কাহিনী এবং সকল কল্পকাহিনী, সকল ধর্মের প্রতিষ্ঠাতারা, এমনকি সকল ধর্ম …….. অপেক্ষা করছে সেলুলয়েডে নিজেদের পুনরুত্থানের জন্য, এবং বীর পুরুষেরা দরজায় ঝাঁপিয়ে পড়ছেন”, তিনি পাঠকদের যারা নিঃসন্দেহে কোনো খবরই রাখেন না তাদের ব্যাপক এক দেউলিয়াত্বের সাক্ষী হওয়ার আমন্ত্রণ জানান।

টীকাঃ

৩. অবশ্যই শিল্পকর্মের ইতিহাস এর চেয়ে বেশি কিছু নিয়ে পরিবেষ্টিত থাকে। যেমন, মোনালিসার ইতিহাস সতেরো, আঠারো এবং ঊনিশ শতকের বিভিন্ন ধরণ ও অনুলিপির ধারণ করে আছে। [বেনিয়ামিনের নোটঃ ফ্লোরেন্সের শিল্পী ও বিজ্ঞানী লিওনার্দো দা ভিঞ্চি (১৪৫২ – ১৫১৯) ১৫০৩ – ১৫০৬ এর দিকে মোনালিসা এঁকেছিলেন। এটি এখন লুভর মিউজিয়ামে সংরক্ষিত। – অনুদিত]

৪. যথার্থ কারণ হলো নির্ভেজালত্ব পুনরুৎপাদনযোগ্য নয়, পুনরুৎপাদনের নির্দিষ্ট (প্রযুক্তিগত) প্রক্রিয়াগুলির নিবিড় অনুপ্রবেশ নির্ভজালত্বকে পৃথক এবং ধীরে ধীরে এক রং থেকে অন্য রঙে পরিবর্তিত হওয়ার টেকনিকের (gradating) ক্ষেত্রে সহায়তা করে। এই ধরনের পার্থক্যে উন্নীত করা শিল্পকর্মের নিজস্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এই ধরনের কাজ কাঠের খোদাইয়ের বিভিন্ন ছাপচিত্র (খোদাইয়ের আগে এবং পরে), তামার পাত্রে খোদাইয়ের বিভিন্ন প্রিন্টের মধ্যে পার্থক্য করার সুস্পষ্ট সুযোগ তৈরি করে। কাঠের খোদাইয়ের উদ্ভাবন এমনকি তার বিলম্বিত বিকাশের আগেই নির্ভেজালত্বের মানের মূলে হয়ত আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিলো। ম্যাডোনার মধ্যযুগীয় একটি চিত্র যে সেই সময়েই তৈরি করা হয়েছিলো তার “নির্ভেজালত্ব” তখনও নিশ্চিত ছিল না। পরবর্তী শতাব্দীগুলিতে তা “নির্ভেজাল” হয়ে ওঠে এবং সম্ভবত উনিশ শতকের দিকে সবচেয়ে লক্ষনীয়ভাবে তা ঘটে। [বেনিয়ামিনের নোট]

৫. গ্যটের ফাউস্টের দীনহীন প্রাদেশিক মঞ্চায়ন ফাউস্ট নিয়ে তৈরি কর্মা চলচ্চিত্রের চেয়ে উচ্চমানের এই অর্থে যে, আদর্শভাবে তা ওয়েমারে প্রথম অভিনয়ের সাথে প্রতিযোগিতা করে। সিনেমাহলের পর্দায় ঐতিহ্যের টুকরা টুকরা অংশগুলি স্মরণ করে কোনো ফায়দা দর্শকরা পায় না যা মঞ্চের সামনে মনে পড়ে যেতে পারে – যেমন, মেফিস্টোর চরিত্রে গ্যটের বন্ধু জোহান হেইনরিচ মের্ক । [বেনিয়ামিনের নোট। গ্যটের ফাউস্টের প্রথম এবং দ্বিতীয় অংশের প্রথম অভিনয় ১৮৭৬ সালে ওয়েমারে হয়েছিল। জোহান হেইনরিচ মের্ক (১৭৪১ – ১৭৯১ ) একজন লেখক, সমালোচক, এবং অনুবাদক, পাশাপাশি একজন পেশাদার ফার্মাসিস্ট, তিনি সাময়িকী Frankfurter gelehrte Anzeigen (১৭২২) খুঁজে পেতে সহায়তা করেছিলেন যেখানে গ্যটের প্রথম দিকের কিছু লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। ফাউস্টে মেফিস্টোর প্রতিকৃতির জন্য গ্যটে তার যৌবনকালের এই বন্ধুর (যিনি পরে আত্মহত্যা করেছিলেন) কিছু ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন – যেমন, তাঁর স্থির ও বিশ্লেষনী মন, বিদ্রূপ ও উপহাস নিয়ে তাঁর অপার ভালবাসা, এবং মানবিক বিষয়ে তাঁর ধ্বংসাত্মক, শূন্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। – অনুদিত]

৬. Abel Gance, “Le Temps de l’image est venue!” (এখনই ছবির সময়!), in Leon Pierre-Quint, Germaine Dulac, Lionel Landry, and Abel Gance, L’Art cinematographique, খণ্ড 2 (প্যারিস, ১৯২৭), পৃষ্ঠা ৯৪ – ৯৬। [বেনিয়ামিনের নোট. Gance (১৮৮৯ – ১৯৮১) একজন শীর্ষস্থানীয় ফরাসি চলচ্চিত্র পরিচালক ছিলেন, যার মহাকাব্যিক চলচ্চিত্র J’Accuse (১৯১৯), La Roue (১৯২২) এবং Napoleon (১৯২৭) সুপারইম্পোজিশন, দ্রুত ইন্টারকাটিং এবং বিভক্ত স্ক্রিনের মতো টেকনিকগুলি অভিনবভাবে ব্যবহার করেছেন। -অনুদিত]

Leave a Reply

আপনি এখান থেকে কপি করতে পারবেন না!