প্রযুক্তিগত পুনরুৎপাদনযোগ্যতার যুগে শিল্পকলার ভূমিকা (পর্ব ৪) / ওয়াল্টার বেনিয়ামিন

৩.
দীর্ঘ ঐতিহাসিক সময়কালে যেমন মানুষের যৌথ অস্তিত্বের পুরা ধরণ পরিবর্তিত হয়, তেমনি তাদের উপলব্ধির পদ্ধতিটিও। মানুষের উপলব্ধি যেভাবে সংগঠিত হয় এবং যার মাধ্যমে তা ঘটে তা কেবল প্রকৃতি নয় ইতিহাস দ্বারাও নিয়ন্ত্রিত। জনমানুষের অভিবাসনের যুগে যখন মানুষ দেখেছে শেষ দিকের রোমান শিল্পকলার খাত এবং ভিয়েনা জেনেসিসের উত্থান যা কেবল প্রাচীনকালের শিল্পকলার চেয়ে আলাদা নয়, বরং তা একটি ভিন্ন উপলব্ধিও গড়ে তুলেছে। ভিয়েনা ধারার বিদ্বান – রিগল (Riegl) এবং উইকফ (Wickhoff) – ধ্রুপদী ঐতিহ্যের গুরুত্ব প্রতিহত ক’রে তার নীচে এই শিল্পকলার কবর রচনা করেছে, এবং তারাই প্রথম এই শিল্পকলা উৎপাদনের সময়কার সংগঠিত উপলব্ধি সম্পর্কে নিজস্ব সিদ্ধান্ত হাজির করেছেন। ৭ তাদের অন্তর্দৃষ্টি সুদূরপ্রসারী হলেও এই বিদ্বানরা নিয়মনিষ্ঠতার (formal) যে স্বাক্ষর শেষদিকের রোমানদের ধারণার বৈশিষ্ট্যের মধ্যে হাজির ছিল তা তুলে ধরে সন্তুষ্ট ছিলেন। তারা উপলব্ধির এই পরিবর্তনে প্রকাশিত সামাজিক উত্থান-পতনের যে চিত্র তা দেখানোর চেষ্টা করেনি – এবং সম্ভবত তা করার চিন্তাও করেনি। আজ সেরকম অন্তর্দৃষ্টির শর্তাগুলি অনেক অনুকূল। এবং বর্তমান সময়ের উপলব্ধির উপায়গুলিতে যদি পরিবর্তনকে জ্যোতির ক্ষয় হিসাবে বোঝা যায় তবে সেই ক্ষয়ের সামাজিক নির্ধারকগুলি প্রদর্শন করা সম্ভব।

রেমব্র্যাঁ: ডাঃ নিকোলাইস টল্পের Anatomy Lesson

ঐতিহাসিকতার নির্দেশনায় জ্যোতির যে ধারণা উপরে প্রস্তাবিত হয়েছে তা প্রাকৃতিক বস্তুর জ্যোতির নির্দেশনায় কার্যকরভাবে চিত্রিত করা যেতে পারে। আমরা প্রাকৃতিক বস্তুর জ্যোতিকে দূরত্বের অনন্য অপচ্ছায়া হিসাবে সংজ্ঞায়িত করি, তা যতই কাছাকাছি সময়ের হোক না কেন। ৮ গ্রীষ্মের বিকেলে বিশ্রামের সময় – দিগন্ত বিস্তৃত পর্বতমালা বা গাছের একটি শাখার যে ছায়া আমাদের চোখে আটকে যায় তা-ই হলো ঐ পর্বতমালার, ঐ শাখার জ্যোতি। বর্ণনার এই আলোকে আমরা জ্যোতির বর্তমান ক্ষয়ের সামাজিক ভিত্তিটি সহজেই উপলব্ধি করতে পারি। দুটি পরিস্থিতির উপর তা নির্ভর করে, উভয়ই সমসাময়িক জীবনে জনমানুষের ক্রমবর্ধমান গুরুত্বের সাথে যুক্ত। এই দুই পরিস্থিতি হলোঃ একালের জনমানুষ কতটা “নিকটবর্তী” হতে চায় স্থানিক ও মানবিকভাবে সেই বাসনা এবং একইভাবে প্রতিটি জিনিসের স্বাতন্ত্র্যকে [Vberwindung des Einmaligen jeder Gegebenheit] পুনরুৎপাদন হিসাবে অঙ্গীভূত করে অতিক্রম করার একান্ত উদ্বেগ।৯ একটি চিত্র [Bild], বা আরও ভালভাবে বললে, একটি অনুলিপি [Abbild], একটি পুনরুৎপাদনে নিকট থেকে একটি বস্তুর উপলব্ধি ধরে রাখতে প্রতিদিন আগ্রহ বাড়ছে। সচিত্র ম্যাগাজিন এবং সংবাদের মধ্যে যে পুনরুৎপাদন [Reproduktion] তা চিত্র থেকে সন্দেহাতীতভাবে আলাদা। স্বাতন্ত্র্য এবং স্থায়ীত্ব এই পরেরটির ক্ষেত্রে যেমন নিবিড়ভাবে জড়িত তেমনি আগেরটির ক্ষেত্রে ক্ষণস্থায়ীত্ব এবং পুনরাবৃত্তি। বস্তু থেকে ঘোমটা ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া বা জ্যোতির ধ্বংস হলো “বিশ্বে একই-রকমতা উপলব্ধির”১০ যে ধারণা তার স্বাক্ষর, আর সেই উপলব্ধি এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, পুনরুৎপাদনের মাধ্যমে অনন্যতার ভিতর থেকেও তা একই-রকমতার নির্যাস বের ক’রে আনছে। এই উপলব্ধি তাত্ত্বিক ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান পরিসংখ্যানগত গুরুত্ব লক্ষ্য করার মত। জনমানুষের সাথে বাস্তবতার এবং জনমানুষের বাস্তবতার সমতা হলো চিন্তার এবং উপলব্ধির জন্যই অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া।

৭. অ্যালোইস রিগল (Alois Riegl) (১৮৮৮ – ১৯০৫) শিল্পকলার একজন অস্ট্রিয়ান ইতিহাসবিদ যিনি যুক্তি দেখিয়ে ছিলেন যে বিভিন্ন ঐতিহাসিক যুগের প্রকাশের সাথে শিল্পকলার নিয়মনিষ্ঠাক্রম (formal orderings) প্রকাশ পায়। তিনি Stilfragen: Grundlegungen zu einer Geschichte der Ornamentik (Questions of Style: Toward a History of Ornament; ১৮৯৩) এবং Die Spiitromische Kunst-Industrie nach den Funden in Osterreich- Ungarn (১৯০১) বই দুইটির লেখক। পরের বইটি অনুবাদ করেছেন রোল্ফ উইঙ্কস (Rolf Winks) Late Roman Art Industry এই নামে (রোমঃ Giorgio Bretschneider Editore, ১৯৮৫)। ফ্রেঞ্জ উইকহফ (Franz Wickhoff) (১৮৫৩ – ১৯০৯), শিল্পকলার একজন অস্ট্রিয়ান ইতিহাসবিদ, টিনই লিখেছেন Die Wiener Genesis (The Vienna Genesis; ১৯২২), জেনেসিসের বাইবেলের গ্রন্থের ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রারম্ভিককালের একটি গবেষণার অনুলিপি ভিয়েনায় অস্ট্রিয়ান জাতীয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে।

৮. “Einmalige Erscheinung einer Ferne, so nah sie sein mag.” গ্রীক ভাষায় aura অর্থ “বায়ু”, “শ্বাস”।

৯. জনমানুষের নিকটবর্তী হওয়া (মানুষের আগ্রহের দিক থেকে) মানে দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্র থেকে মানুষের সামাজিক ভূমিকাকে সরিয়ে নেয়া। একজন প্রতিকৃতি তৈরি করা শিল্পী যখন তার পরিবারের সাথে সকালে নাস্তার টেবিলে বসে চিত্রাঙ্কন করছেন তখন তিনি সতেরো শতকের একজন চিত্রকরের চেয়ে তাঁর সামাজিক ভূমিকাকে আরও স্পষ্টভাবে চিত্রিত করেন, যিনি দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষন করেন পেশার প্রতিনিধিত্বকারী চিকিৎসকের, যেমন রেমব্র্যাঁ তার শারীরবৃত্তীয় (anatomy) পাঠে করেছিলেন। [বেনিয়ামিনের নো। রেমব্র্যাঁ (১৬০৬ -১৬৬৯) হলেন একজন ডাচ চিত্রকর এবং খোদাই শিল্পী যিনি ১৬৩২ সালে ডাঃ নিকোলাইস টল্পের শারীরবৃত্তীয় (anatomy) পাঠের চিত্র এঁকেছিলেন। চিত্রটি হেগে মরিশতুইতে রক্ষিত আছে। – অনুদিত]

১০. বেনিয়ামিন উদ্ধৃত করছেন জোহানেস ভি. জেনসেন, Exotische Novel/en, অনুবাদকঃ জুলিয়া কোপেল (বার্লিন: এস ফিশার, ১৯১৯), পৃষ্ঠা ৪১ – ৪২. জেনসেন (১৮৭৩ – ১৯৫০) একজন ডেনিশ উপন্যাসিক, কবি এবং প্রাবন্ধিক যিনি ১৯৪৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছিলেন। দেখুন “Hashish in Marseilles,” বেনিয়ামিনে, নির্বাচিত রচনাবলী, খণ্ড ২ঃ ১৯২৭ – ১৯৩৪ (কেমব্রিজ, ম্যাসাচুসেটসঃ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস, ১৯৯৯), পৃষ্ঠা ৬৭৭।

Leave a Reply

আপনি এখান থেকে কপি করতে পারবেন না!