প্রযুক্তিগত পুনরুৎপাদনযোগ্যতার যুগে শিল্পকলার ভূমিকা (পর্ব ৫) / ওয়াল্টার বেনিয়ামিন

শিল্পকর্মের স্বাতন্ত্র্য অভিন্ন হয়ে ওঠে ঐতিহ্যের প্রেক্ষিতের ভিতর নিহিত থেকে। অবশ্যই এই ঐতিহ্য নিজেই পুরোপুরি জীবিত এবং অত্যন্ত পরিবর্তনশীল। যেমন, ভেনাসের একটি প্রাচীন মূর্তিতে গ্রীক চিরাচরিত ঐতিহ্যের যে প্রেক্ষাপট বিদ্যমান (যারা এটিকে উপাসনার বস্তু হিসাবে তৈরি করেছিল), তা মধ্যযুগীয় খ্রীষ্টীয় যাজকদের প্রেক্ষাপট (যারা এটিকে একটি দুষ্টু প্রতিমা হিসাবে দেখেছিল) থেকে ভিন্ন। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রে যা সমানভাবে স্পষ্ট তা হলো এর স্বাতন্ত্র্য, তার জ্যোতি। মূলত, চিরাচরিত ঐতিহ্যের প্রেক্ষিতের সাথে শিল্পকর্মের এই নিবিড়তা কাল্ট হিসাবে অভিব্যক্তি খুঁজে পেয়েছে। যেমনটি আমরা জানি, প্রথম দিককার শিল্পকর্মগুলি প্রথমে ঐন্দ্রজালিক (magical), পরে ধর্মীয়ের আচার-অনুষ্ঠানে পরিনত হয়েছে। এবং এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে শিল্পকর্মের অস্তিত্বের মধ্যে জ্যোতির ধরনটি কখনো তার আচার অনুষ্ঠান থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়নি।১১ অন্য কথায়ঃ শিল্পকর্মের “নির্ভেজালত্বের” অনন্য মূল্যের ভিত্তি হলো তার আচার-আনুষ্ঠানিকতায় যা তার ব্যবহারিক মূল্যের (use value) উৎস। যে মধ্যস্থতায় বিচার করি না কেন, আচাররীতির এই ভিত্তিটি এখনও এমনকি সৌন্দর্যের সবচেয়ে অপবিত্র কাল্ট রূপে ধর্মনিরপেক্ষ আচাররীতি হিসাবে স্বীকৃত।১২ সৌন্দর্যের ধর্মনিরপেক্ষ উপাসনা যা রেনেসাঁর সময়ে বিকশিত হয়েছিল এবং তিন শতাব্দী ধরে বিরাজমান ছিল তা পরবর্তীকালে ক্ষীণ হয়ে এলেও গুরুতর সংকটের কালে সেই আচাররীতির ভিত্তিকে প্রদর্শন করেছে। কারণ প্রথমবারের মত যখন সত্যিকারের বৈপ্লবিক পুনরুৎপাদনের উপায় আবির্ভূত হওয়ার সাথে সাথে (যেমন, ফটোগ্রাফি আবির্ভূত হয়েছিল সমাজতন্ত্রের সাথে ) শিল্পকলা সেই সংকটের আগমন বুঝতে পেরেছিল, যা এক শতাব্দী পরে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তখন এর প্রতিক্রিয়ায় ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ এই মতবাদ, যাকে শিল্পের ধর্মতত্ত্ব বলা যায় তার আবির্ভাব হল। পালাক্রমে “খাঁটি” শিল্প-ধারণার নামে একটি নেতিবাচক ধর্মতত্ত্বের জন্ম হল; এই ধর্মতত্ত্ব প্রতিনিধিত্বমূলক বিষয় হিসাবে শিল্পের কেবল সামাজিক ভূমিকাই নয় তার সংজ্ঞাও অস্বীকার করল। (কবিতায় মালার্মেই প্রথম এই অবস্থানটি গ্রহণ করেছিলেন।)১৩

প্রযুক্তিগত পুনরুৎপাদনযোগ্যতার যুগে শিল্পকর্মের উপর কোনো তল্লাশ এই সম্পর্কগুলি উপেক্ষা করতে পারে না। এই সম্পর্কগুলি একটি গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্দৃষ্টির খোঁজ দেয়ঃ বিশ্ব ইতিহাসে এই প্রথমবারের মত প্রযুক্তিগত পুনরুৎপাদনযোগ্যতা শিল্পকর্মকে পরজীবী অধীনতা থেকে আচার-আনুষ্ঠানিকতা মুক্ত করে দেয়। ক্রমবর্ধমানভাবে পুনরুৎপাদিত শিল্পকর্ম পুনরুৎপাদনযোগ্যতার জন্যই পুনরুৎপাদন হয়ে ওঠে।১৪ উদাহরণস্বরূপ, ফটোগ্রাফিক প্লেট থেকে যে কেউ যত-ইচ্ছা প্রিন্ট তৈরি করতে পারে; কোনটা “খাঁটি” প্রিন্ট তা জানতে চাওয়া অনর্থক। তবে শৈল্পিক উৎপাদনের নির্ভেজালত্বের মানদণ্ডের অবসান হওয়ার সাথে সাথে শিল্পের পুরো সামাজিক ভূমিকা এক বৈপ্লবিক আকার ধারণ করে। আচাররীতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত না-হয়ে তা একটি ভিন্ন অনুশীলনের উপর প্রতিষ্ঠা লাভ করেঃ রাজনীতি।

টীকাঃ
১১. “দূরত্বের এক অনন্য আবির্ভাব, যতই নিকটবর্তী হোক-না কেন” জ্যোতির (aura) এই সংজ্ঞা যা বোঝায় তা স্থানিক উপলব্ধির শ্রেণিতে শিল্পকর্মের আচার-মূল্য নির্ধারণের চেয়ে বেশি কিছু নয়। দূরত্ব হল নিকটবর্তিতার বিপরীত। যা মূলত দূরের তা সগজগম্য নয়। এই অসহজগম্যতাই হল কাল্ট প্রতিচ্ছবির একটি প্রাথমিক গুণ; তার নিজস্ব প্রকৃতির দিক থেকেই কাল্ট প্রতিচ্ছবি হয়ে থাকে “দূরের, যত কাছাকাছি হোক-না কেন।” [বেনিয়ামিনের নোট]
১২. কোনো পটচিত্রের কাল্ট-মূল্য যতখানি ধর্মনিরপেক্ষতার ছোঁয়া পায়, তার মৌলিক স্বাতন্ত্র্যের ছাপগুলি ততখানি কম সুনিশ্চিত হয়। দর্শকের কল্পনাশক্তিতে কাল্ট ছবির ভিতরকার স্বাতন্ত্র্যের দোলাচালের এই ব্যাপারটি শিল্পীর অভিজ্ঞতাজাত স্বাতন্ত্র্য বা তার সৃজনশীল কৃতিত্বের দ্বারা আরও বেশি বেশি বাস্তুচ্যুত হয়। তবে তা পুরাপুরি হয় না – নির্ভেজালত্বের ধারণাটি সবসময়েই যথাযথ আরোপণের ধারণাকে অতিক্রম করে যায়। (চিত্রসংগ্রাহকদের মধ্যে আমরা এই ব্যাপারটি দেখতে পাই, তারা সবসময়েই বস্তুভক্তির (fetish) বৈশিষ্ট্য ধারণ করে এবং মালিকানার মাধ্যমে তারা শিল্পকর্মের কাল্ট ক্ষমতার জানান দেয়।) তবুও নির্ভেজালত্বের ধারণাটি এখনও শিল্পকর্মের মূল্যায়নের নির্ধারক হিসাবে কাজ করে; শিল্পকর্ম যখনই ধর্মনিরপেক্ষ হতে থাকে তখনই তার নির্ভেজালত্বে কাল্ট-মূল্যকে বাস্তুচ্যুত করে। [বেনিয়ামিনের নোট]
১৩. স্টিফেন মালার্মে (১৮৪২ – ১৮৯৮), ফরাসি কবি, অনুবাদক এবং সম্পাদক, প্রতীকি (Symbolist) আন্দোলনের প্রবর্তক এবং নেতা, যে আন্দোলন নির্দেশনামূলক ভূমিকা থেকে ভাষাকে বিচ্ছিন্ন করে প্রতীকিরূপে ভাষাকে খুঁজেছে। তাঁর রচনাবলীর মধ্যে রয়েছে L’ApresMidi d’un faune (এক ফন-এর দুপুর; ১৮৭৬) এবং Vers et prose (কবিতা ও গদ্য; ১৮৯৩)।
১৪. চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত পুনরুৎপাদনযোগ্যতা তার গণপ্রচারের বাহ্যিক আরোপিত শর্ত হিসাবে ততখানি নয় ঠিক যতখানি বলা যায় সাহিত্য বা চিত্রকলার ক্ষেত্রে। চলচ্চিত্রের প্রযুক্তিগত পুনরুৎপাদনযোগ্যতা সরাসরি উৎপাদনের যে প্রযুক্তি তার উপর নির্ভর করে। এটা তাই কেবলমাত্র চলচ্চিত্রের গণপ্রচারকেই সম্ভব করে তোলে না, এটাই তার বাস্তবতা। এর কারণ হল, চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রক্রিয়াটি এত ব্যয়বহুল যে কোনো ব্যক্তির চিত্রকলার মালিকানার সামর্থ্য থাকতে পারে, কিন্তু, উদাহরণস্বরূপ, চলচ্চিত্রের [একটি মাস্টার প্রিন্ট] মালিক হওয়ার সামর্থ্য থাকে না। ১৯২৭ সালের একটি হিসাবে যানা জায় যে, মুনাফা নিশ্চিত করতে একটি চলচ্চিত্রের নয় মিলিয়ন দর্শকের প্রয়োজন। অবশ্যই শাব্দিক চলচ্চিত্রের আগমনের ফলে (সেই একই বছর) প্রথমদিকে বিপরীত বিপরীত ঘটনাটি ঘটেছিলঃ দর্শকরা ভাষার সীমাবদ্ধয় আটকে গিয়েছিল। এবং এর সাথে যোগ হয়েছিল ফ্যাসিবাদের জাতীয় স্বার্থের উপর গুরুত্ব। তবে ফ্যাসিবাদের সাথে সম্পর্কের চেয়ে এই ব্যাপারটি তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয় (ডাবিং – এর মাধ্যমে এই সমস্যাটি উৎরানো সম্ভব হয়েছিল)। এই দুটি যুগপৎ ঘটনার কারণ ছিল অর্থনৈতিক সংকট। সেই একই ব্যাধি অর্থনৈতিক সংকটের মুখে বিশ্বজুড়ে চলচ্চিত্রের পুঁজির বর্বরতা বিদ্যমান সম্পত্তির সম্পর্ক বজায় রাখার প্রয়াসে শাব্দিক চলচ্চিত্রের দ্রুত বিকাশ চেয়েছিল। ফলে সাময়িক স্বস্তি এসেছিল, কিন্তু তা শুধু এই কারণে নয় যে শাব্দিক চলচ্চিত্র জনসাধারণকে প্রদর্শনহলে আকৃষ্ট করেছিল, সেই সাথে চলচ্চিত্র ও বিদ্যুৎখাতের শিল্প-পুঁজি গাঁটছড়া বেঁধেছিল। এভাবে বাইর থেকে বিচার করলে মনে হবে শাব্দিক চলচ্চিত্র জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছে; ভিতর থেকে বিচারে দেখা যায়, ব্যাপারটি চলচ্চিত্র উৎপাদনকে আগের চেয়েও বেশি আন্তর্জাতিক হয়ে উঠতে সহায়তা করেছে। [বেনিয়ামিনের নোট। “অর্থনৈতিক সংকট” বলতে বেনিয়ামিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে ১৯২৯ সালের অক্টোবরের শেয়ারবাজার দুর্ঘটনার ভয়াবহ পরিণতি বুঝিয়েছেন।)

Leave a Reply

আপনি এখান থেকে কপি করতে পারবেন না!