“যদি ঈশ্বর না-থাকে, তাহলে সবকিছুই অনুমোদিত” এই বক্তব্যটি যদিও দস্তয়ভস্কির ‘দ্য করামাজভ ব্রাদার্স’ উপন্যাসে আছে এমন ধারণাই সবচেয়ে বেশী (সার্ত্রে তাঁর ‘বিয়িং অ্যান্ড নাথিংনেস’ বইয়ে সে-রকমই প্রথম করেছিলেন), আসলে তা ঠিক নয়।
বিশেষখ্যাত এই বচনের সবচেয়ে কাছাকাছি কয়েকটি উদাহরণ আছে মাত্র, যেমন, রাকিতিনের সাথে বিতর্কে দিমিত্রির দাবী (যখন সে আলিওশাকে বলছিলো):
‘কিন্তু তখন মানুষের কি হবে?’ আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ঈশ্বর ছাড়া এবং অমর জীবন? সবকিছুই তাহলে অনুমোদিত, তারা যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারে? ‘
কিন্তু বিভ্রান্তটি যে দশকের পর দশক ধরে অব্যাহত রয়েছে তা প্রমাণ করে যে, এই সত্যটি, এমনকি যদি ভুলও হয়, তাহলেও তা আমাদের আদর্শিক সৌধের ভিত্তিতে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। নাস্তিক-ভোগসুখবাদী অভিজাতদের কেলেঙ্কারী দেখলেই রক্ষণশীলরা এই ব্যাপারটি নতুন করে উত্থাপন করে – এতে আশ্চর্য হবার মতো কিছুই নাইঃ লাখ লাখ মানুষ গুলাগে – এই ব্যাপার থেকে শুরু করে জন্তুর সাথে যৌনতা এবং সমকামী বিবাহ পর্যন্ত সবক্ষেত্রে আমাদের নিশানা এসে ঠেকে পরমের কর্তৃত্বের প্রশ্নে, যদি আমরা সমস্ত মানবিক প্রচেষ্টার চূড়ান্ত সীমা হিসাবে এই কর্তৃত্বকে অস্বীকার করি।
ফলে এই ধারনা থেকে আমাদের কল্পনার ডালপালা ছড়াতে থাকে – এ জাতীয় পরমের সীমা ছাড়া প্রতিবেশীদের নির্মমভাবে শোষণ করা, তাদের মুনাফা আর আনন্দের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা বা তাদের দাসে পরিণত করা, অবমাননা করা ও লাখে লাখে তাদের হত্যা করা – এসব কিছু চূড়ান্তভাবে প্রতিহত করার মতো আর কিছুই আমাদের কাছে নাই। পরমের সীমার অনুপস্থিতিতে আমাদের এবং এই নৈতিক শূন্যতার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে স্ব-আরোপিত সীমাবদ্ধতা এবং স্বেচ্ছামাফিক ‘নেকড়েদের মধ্যে সন্ধি’ যার লক্ষ্য বেঁচে থাকা ও সাময়িক কল্যাণের স্বার্থ, কিন্তু তা লঙ্ঘিত হতে পারে যে কোনো মুহুর্তে।
কিন্তু বিষয়টি কি আসলেই এরকম? এটি সুপরিচিত যে, জ্যাঁ লাঁকা দাবি করেছিলেন যে মনোবিশ্লেষণমূলক অনুশীলন দস্তয়ভস্কির নীতিবাক্যটিকে উল্টিয়ে দিবেঃ “যদি ঈশ্বর না থাকে, তবে সবকিছুই নিষিদ্ধ।” এই উল্টা-কথা অবশ্যই নৈতিকতা নিয়ে সাধারণ জ্ঞানের বিপরীত। সুতরাং, যেমন, লাঁকা সম্পর্কিত একটি বইয়ের অন্যথায় সহানুভূতিশীল এক পর্যালোচনায় একটি স্লোভেনীয় বামপন্থী দৈনিক পত্রিকা লাঁকার কথাকে এইভাবে উপস্থাপন করেছিলঃ “ঈশ্বর যদি না-ও থাকে, তবে সবকিছুই অনুমোদিত নয়!” – এ এক উদার অশ্লীলতা, এটি লাঁকার উস্কানিমূলক উল্টা-কথাকে পরিবর্তনের মাধ্যমে এমন একটি পরিমিত আশ্বাসে পরিণত করেছে যে এমনকি আমরা, ঈশ্বরহীন এই নাস্তিকরাও, কিছুটা হলেও নৈতিক সীমা সম্মান করি ।
সে যাই হোক, লাঁকার উল্টা-কথাটি যদি আপাত-বিপরীত শূন্যতা ব’লে মনে হয়, তাহলে আমাদের নৈতিকতার পটে একটু নজর দিলে এটি নিশ্চিত হয় যে, এ হলো নাস্তিক্যবাদী উদার / ভোগসুখবাদীর আচরণের যুক্তিযুক্ত বর্ণনাঃ তারা তাদের জীবনকে সুখের সাধনায় উৎসর্গ করে, কিন্তু যেহেতু তাদের এই সাধনার জন্য ব্যক্তিগত সুযোগের নিশ্চয়তা প্রদানে কোনো বাহ্যিক কর্তৃত্ব নাই, তাই তারা “রাজনৈতিকভাবে ঠিক” এমন স্ব-আরোপিত বিধির একটি নিবিড় নেটওয়ার্কে জড়িয়ে পড়ে, মনে হয় প্রচলিত নৈতিকতার চেয়ে অনেক বেশি মারাত্মক পরমের (superego) কাছে তারা জবাবদিহি করতে সক্ষম। এভাবে তারা নিজেদের আনন্দের খোঁজে এমন উদ্বেগের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে যে তা অন্যের সুযোগকে লঙ্ঘন করতে পারে, এবং তাই নিজেদের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে বিশদ বিধান গ্রহণ যেন তারা অন্যদের “হয়রানি” করার সম্ভাবনা এড়িয়ে যেতে পারে, পারে একইসাথে নিশ্চিত করতে নিজের যত্নের জটিল আমল (শারীরিক সুস্থতা, স্বাস্থ্যকর খাবার, আধ্যাত্মিক উদ্বেগের শিথিলতা, ইত্যাদি)।
সাধারণ এক ভোগসুখবাদী হওয়ার চেয়ে আজ কোন কিছুই এত পীড়াদায়ক এবং নিয়ন্ত্রাধীন নয়।
তবে এখানে দ্বিতীয় একটি পর্যবেক্ষণ আছে যা প্রথমটির সাথে যথাযতভাবে সম্পর্কিতঃ তারা নিজেদেরকে “ঈশ্বরের” ইচ্ছার উপায় হিসাবে উপলব্ধির মাধ্যমে তাঁকে এমন নির্মমতায় সরাসরি সম্পর্কযুক্ত করে যেন সবকিছুই অনুমোদিত। অবশ্যই এরা হলো তথাকথিত মৌলবাদী যারা অনুশীলন করে এমন এক বিকারগ্রস্থ ধরণ কিয়ের্কেগার্ড যাকে নৈতিকতার ধর্মীয় মুলতবি বলেন।
তাহলে কেন আজ আমরা ধর্ম (বা জাতির) দোহাই দিয়ে সংঘটিত সহিংসতার উত্থান লক্ষ্য করছি? স্পষ্টতই এর কারণ হলো, আমরা এমন এক যুগে বাস করি যা নিজেকে উত্তর-ভবাদর্শ হিসাবে উপলব্ধি করে। যেহেতু মহৎ জনস্বার্থ আজ আর গণ-সহিংসতার ভিত্তি হিসাবে পরিচালিত করতে পারছে না, হেজিমোনিক মতাদর্শ (hegemonic ideology) জীবনকে উপভোগ করতে, সত্যিকারের আত্ম উপলব্ধির পথে বাঁধা দেয়; ফলে একজন মানুষ কর্তৃক অন্য আরেকজন মানুষের হত্যার সম্ভাবনার মধ্যে মনোভাবের যে আকস্মিক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় বেশিরভাগ মানুষের পক্ষে তা অতিক্রম করা সম্ভব না।
বেশিরভাগ মানুষই আজ স্বতঃস্ফুর্তভাবে নীতিবানঃ একজন মানুষ কর্তৃক অন্য আরেকজনের নির্যাতন বা হত্যার ধারণা মানসিকভাবে গভীর কষ্টদায়ক। ফলে এই নির্যাতন বা হত্যা ঘটানোর জন্য এমন একটি বৃহত্তর “পবিত্র” কারণ প্রয়োজন হয় যা হত্যা নিয়ে নগণ্য যে কোনো ব্যক্তির উদ্বেগকে মামুলী করে তোলে। ধর্ম বা নৃ-গোষ্ঠীর নামে এই উদ্দেশ্য পুরাপুরি সফল হয়। অবশ্যই এমন বিকারগ্রস্থ নাস্তিক রয়েছেন যারা কেবল আনন্দের জন্য বা গনহত্যার জন্য গনহত্যা করতে সক্ষম, তবে তা বিরল ব্যতিক্রম। বেশিরভাগ মানুষের মধ্য থেকে সেজন্য অন্যের দুর্ভোগের প্রতি প্রাথমিক সংবেদনশীলতার যে অনুভূতি তা বিলোপ করা দরকার। সে কারণে একটি পবিত্র উদ্দেশ্য দরকারঃ এই উদ্দেশ্য ছাড়া আমরা যা করেছি তা আমাদের বোঁঝার ভারে পরিণত হতে বাধ্য, কোনো পরম – এক ও অদ্বিতীয় ছাড়া চূড়ান্ত দায়বদ্ধতাটি আর কারো উপর রাখতে পারি না।
সত্য হোক বা না-হোক, ধর্মীয় মতাদর্শবাদীরা সাধারণত দাবি করেন যে, ধর্ম কিছু খারাপ লোককে কিছু ভাল কাজ করতে বাধ্য করে। আজকের অভিজ্ঞতা থেকে তাহলে স্টিভেন ওয়েইনবার্গের দাবীর উপর আমাদের বিশ্বাস স্থাপন করা উচিতঃ ধর্ম না থাকলে ভাল লোকেরা ভাল কাজ করতে থাকবে এবং মন্দ লোকেরা খারাপ কাজ, কেবল ধর্মই ভাল মানুষকে খারাপ কাজ করতে সাহায্য করতে পারে। তথাকথিত “মানবিক দুর্বলতা” প্রদর্শনের ক্ষেত্রেও সমানে সমান একই কথা খাটে। ধর্মহীন ভোগসুখবাদীদের মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে যৌনতার যেসব চূড়ান্ত বিভিন্ন ধরণ দেখা যায় সেগুলি তাৎক্ষণিকভাবে ধর্মহীনতার প্রতিনিধিত্বমূলক চিহ্ন হিসাবে বিবেচিত হয়, আর অন্যদিকে কথিত ব্যাপক যাজকীয় শিশু যৌননিপীড়ন এবং চার্চের যোগসূত্রটি নিয়ে যে কোনো প্রশ্নকে অধর্মীয় অপবাদ হিসাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়। ক্যাথলিক চার্চ তার নিজের কোন মর্যাদার বলে শিশু যৌননিপীড়কদের রক্ষা করেছে সে সম্পর্কে সুপ্রতিষ্ঠিত কাহিনীগুলি ভাল উদাহরণ হিসাবে বিবেচনা ক’রে এই সত্য উচ্চারণ করা যেতে পারে, ঈশ্বর যদি থেকে থাকে তাহলে সবকিছুই অনুমোদিত। শিশু যৌননিপীড়কদের প্রতি এই প্রতিরক্ষামূলক মনোভাবটি এতই ঘৃণ্য প্রকৃতির যে সব-কিছুই-অনুমোদিত বিশ্বাসে বিশ্বাসী ভোগসুখবাদীরা এই চর্চায় নিয়োজিত নয়, বরং এমন একটি প্রতিষ্ঠান যে-কিনা সামাজিক নৈতিকতার অভিভাবক হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে সে-ই এই চর্চা করে যাচ্ছে।
স্ট্যালিনবাদী কমিউনিস্টদের গণহত্যা তাহলে কি? নামহীন লক্ষ লক্ষ মানুষের আইন বহির্ভূত হত্যা? এটি সহজেই বোঝা যায় কিভাবে এই অপরাধগুলি সবসময়েই নিজস্ব এর্সাতজ-ঈশ্বর (ersatz-god) দ্বারা ন্যায়সঙ্গত করা হয়েছিল, প্রাক্তন হতাশ কমিউনিস্টদের একজন, ইগনাজিও সিলোন, যাকে বলেছেন “সেই ঈশ্বর যিনি ব্যর্থ” – তাদের নিজস্ব ঈশ্বর ছিল, এ কারণেই সবকিছু তাদের জন্য অনুমোদিত ছিল।
অন্য কথায়, ধর্মীয় সহিংসতার এই একই যুক্তি এখানেও প্রযোজ্য। স্টালিনবাদী কমিউনিস্টরা নিজেদের স্বাধীনতা পরিত্যাগকারী ভোগসুখবাদী হিসাবে উপলব্ধি করে না। বরং তারা নিজেদেরকে ঐতিহাসিক অগ্রগতির হাতিয়ার হিসাবে মনে করে, এমন একটি প্রয়োজনীয়তা যা মানবতাকে কমিউনিজমের “উচ্চতর” পর্যায়ে উন্নীত করবে এবং এটিই তাদের নিজস্ব পরম (এবং এই পরমের সাথে তাদের সুবিধাপ্রাপ্ত সম্পর্ক) যা তাদের যা ইচ্ছা তা করার অনুমতি দেয়।
এই কারণেই তাদের এই আদর্শিক প্রতিরক্ষামূলক ঢালে ফাটল দেখা দেয়ার সাথে সাথে তাদের কৃতকর্মের ভার অনেক কমিউনিস্টের পক্ষে বহন করা অসম্ভব হয়ে ওঠে, কারণ, ইতিহাসের উঁচুমানের যৌক্তিকতার অজুহাতের অভাবে তাদেরকে নিজস্ব কৃতকর্মের মুখোমুখী হতে হয়েছে। আর এই কারণেই স্ট্যালিনের অপরাধের নিন্দা করে ক্রুশ্চেভের দেয়া ১৯৫৫ সালের ভাষণের পর অনেক কর্মী আত্মহত্যা করেছিলোঃ তারা এই ভাষণের সময় নতুন কিছুই শিখেনি, সমস্ত ঘটনা তাদের কম-বেশি জানা ছিল, তারা কমিউনিস্টদের ঐতিহাসিক পরমের মধ্যে কেবল তাদের অপরাধের ঐতিহাসিক বৈধতা খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়েছিলো।
এই যুক্তিতে স্ট্যালিনিজম এবং অনেকাংশে ফ্যাসিবাদ আরও একটি বিকৃত মোড় যুক্ত করেছেঃ নিজেদের ক্ষমতা ও নির্মম সহিংসতার অনুশীলনকে ন্যায়সঙ্গত করার জন্য তারা শুধু পরমের সাধন হিসাবে তাদের নিজস্ব ভূমিকাকে উন্নীত করেনি, প্রতিপক্ষকে অসুর বানিয়ে ছেড়েছে, তাদের দুর্নীতিগ্রস্থ ও অধঃপতিত রূপে চিত্রিত করেছে।
নাৎসীরা দুরাচারের প্রতিটি ঘটনাকে তাৎক্ষনিভাবে ইহুদী অবক্ষয়ের প্রতীক হিসাবে চিহ্নিত করেছিলো; আর্থিক ফটকাবাজি, সমর বিরোধীতাবাদ, সাংস্কৃতিক আধুনিকতা, যৌন স্বাধীনতা ইত্যাদির মধ্যে এক ধারাবাহিকতার সম্পর্ক খুঁজেছে যেন এসব একই ইহুদী নির্যাস থেকে উদ্ভূত, একই অর্ধেক অদৃশ্য সংস্থা (half invisible agency) যা গোপনে সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করতো। এমনভাবে অসূরে রূপান্তরের যথাযথ কৌশলগত কারণ ছিলোঃ এটি নাৎসীদেরকে যা খুশি তাই করার ন্যায্যতা দেয় যেহেতু এইরকম শত্রুর বিরুদ্ধে সমস্ত কিছুই অনুমোদিত, কারণ আমরা স্থায়ী জরুরী অবস্থার (permanent state of emergency) মধ্যে বসবাস করছি।
এবং সবশেষে এখানে একটি চূড়ান্ত বিদ্রূপাত্মক কথা মনে রাখা উচিতঃ যারা পরমের সীমার সংহতি ভেঙ্গে যাবার জন্য পরিতাপ করেন, তাদের অনেকেই নিজেদের যদিও খ্রিস্টান হিসাবে পরিচিতি দেন, একটি নতুন বাহ্যিক / পরমের সীমা জন্য বাসনা আসলে গভীরভাবে অখ্রীস্টিয়। খ্রিস্টীয় ঈশ্বর সীমাবদ্ধতার পরম ঈশ্বর নন, বরং অগাধ ভালবাসার ঈশ্বরঃ ঈশ্বর, সর্বোপরি, ভালবাসা; তিনি তখনই হাজির যখন তাঁর অনুসারীদের মধ্যে ভালবাসা বিরাজ করে।
আশ্চর্য হওয়ার মত এমন কিছু নয় যে, “যদি ঈশ্বর থাকে তবে সবকিছুই অনুমোদিত!” লাঁকার এই উল্টা-কথাটি কোনো কোনো খ্রিস্টান ব্যক্তি প্রকাশ্যে উল্লেখ করে থাকেন।
ভালবাসায় বিধিনিষেধ কাটিয়ে উঠার তাগিদে (overcoming of the prohibitive Law in love) খ্রিষ্টীয় ধারণার ফলঃ আপনি যদি ঐশ্বরিক ভালবাসায় বাস করেন তবে আপনার বিধিনিষেধের দরকার নাই; আপনি যা চান তা-ই করতে পারেন, কারণ সত্যিই যদি আপনি ঐশ্বরিক ভালবাসায় বাস করেন, তাহলে আপনি কখনও কোনও খারাপ কাজ করতে চাইবেন না।
“মৌলবাদী” নৈতিকতার এই ধর্মীয় ছেদের সূত্রটি যথারীতি অগাস্টিন প্রস্তাব করে লিখেছিলেন, “ঈশ্বরকে ভালবাসুন এবং যেমনটি করলে আপনি সন্তুষ্ট হবেন তেমনটি করুন” (অন্যভাবে, “ভালবাসুন এবং যা চান তা-ই করুন”। খ্রিস্টীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এই দুইটি আসলে একই অর্থ, যেহেতু ঈশ্বরই ভালবাসা)। ফাঁদটি হলো, যদি আপনি সত্যি সত্যি ঈশ্বরকে ভালোবাসেন তাহলে ঈশ্বর সন্তুষ্ট হবেন এমন যা কিছু ঈশ্বর চান তা আপনাকেও সন্তুষ্ট করবে, আর আপনিও তাই চান, এবং যা ঈশ্বরকে অসন্তুষ্ট করবে তা আপনাকে দুর্দশাগ্রস্ত করে তুলবে। সুতরাং এমনটি নয় যে, আপনি ঈশ্বরের প্রতি আপনার ভালবাসার জন্য “আপনি যা কিছু করতে চান” করতে পারেন, যা করতে চান তা যদি খাঁটি হয়, তবে আপনি সর্বোচ্চ নৈতিক মানই অনুসরণ করছেন।
এটি বরং প্রবাদমূলক কৌতুকের মতো, “আমার ভালবাসার মানুষটি কখনও দেরী করে না, কারণ সে যখন দেরী করে, সে আর আমার ভালবাসার মানুষ নয়।” আপনি যদি ঈশ্বরকে ভালবাসেন তবে আপনি যা চান তা-ই করতে পারেন, কারণ যখন আপনি কোনো খারাপ কাজ করেন তখন এটি নিজেই প্রমাণ হিসাবে হাজির হয় যে আপনি ঈশ্বরকে সত্যি ভালবাসেন না। যাই হোক, ব্যাপারটি দ্ব্যর্থহীন নয় যেহেতু আপনার বিশ্বাসের বাইরে, ঈশ্বরের প্রতি আপনার বিশ্বাস এবং ভালবাসার বাইরে, কোনো নৈতিক মানের অভাবে আপনি যা করতে চান তার কোনো নিশ্চয়তা নাই, সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কর্মকান্ডের বৈধতা হিসাবে ঈশ্বরের প্রতি ভালবাসার যুক্তি ব্যবহারের বিপদজনক ঝুঁকি সবসময় থাকছে।
তার উপর, দস্তয়ভস্কির “ঈশ্বর না থাকলে সবকিছুই অনুমোদিত” এই ধারায় যখন চিন্তাভাবনার একটি পথ প্রস্তাব করেন তখন তিনি কোনোভাবেই সীমাহীন স্বাধীনতার বিরুদ্ধে সতর্কতার বাণী উচ্চারণ করছেন না, মানে, ঈশ্বরকে এক পরমের নিষেধাজ্ঞার কর্তা হিসাবে আবির্ভূত করছেন নাঃ ইনকুইজিশনের দ্বারা যে সমাজ পরিচালিত সে সমাজে অবশ্যই সবকিছু অনুমোদিত নয়, কারণ আমাদের স্বাধীনতার সীমাবদ্ধ উচ্চতর শক্তি হিসাবে ঈশ্বর সেখানে হাজির থাকেন, স্বাধীনতার উৎস হিসাবে নয়। গ্রেট ইনকুইজিটরের দৃষ্টান্তটির পুরা বক্তব্যটিই হলো, এই জাতীয় সমাজ স্বয়ং যীশুর বার্তা ছুঁড়ে ফেলে দেয়ঃ যীশু যদি এই সমাজে ফিরে আসতেন তবে তাঁকে জনশৃঙ্খলা ও সুখের পথে একটি মারাত্মক হুমকিস্বরূপ পুঁড়িয়ে ফেলা হতো, কারণ তিনি মানুষের কাছে স্বাধীনতা এবং দায়িত্বের উপহার (যা প্রকারান্তরে ভারী বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে) এনেছেন।
“যদি ঈশ্বর না থাকে তবে সবকিছুই অনুমোদিত” এই দাবীর অন্তর্নিহিত অর্থ দ্ব্যর্থবোধক, তাই ব্রাদার্স কারামাজভ উপন্যাসটির এই অংশটি, বিশেষত ইভান এবং আলিওশার মধ্যে পঞ্চম অধ্যায়ে যে দীর্ঘ কথোপকথন তার দিকে একটু ঘনিষ্ঠ নজর দেওয়া ভাল। ইভান গ্র্যান্ড ইনকুইজিটর সম্পর্কে আলিওশাকে একটি কল্পিত গল্প বলেছিলেন। ইনকুইজিশনের সময় যীশুখ্রীষ্ট সেভিলে ফিরে এলেন; তিনি বেশ কিছু অলৌকিক কাজ করার পর মানুষ তাঁকে চিনে ফেলে এবং তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়, কিন্তু তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং পরের দিন পুড়িঁয়ে হত্যা করা হয়। গ্র্যান্ড ইনকুইজিটর যীশুখ্রীষ্টকে তাঁর কক্ষে গিয়ে বলেছিলেন যে, চার্চের তাঁর আর দরকার নাইঃ তাঁর ফিরে আসা চার্চের যে মিশন – মানুষের সুখের আনয়ন – তা বাঁধাগ্রস্থ করবে। যীশুখ্রীষ্ট মানব প্রকৃতিকে বিপথে পরিচালিত করেছেনঃ অন্যভাবে বললে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে তিনি যে স্বাধীনতা দিয়েছেন তা তারা সামলাতে পারছে না, মানুষকে বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দিয়ে যীশুখ্রীষ্ট বেশিরভাগ মানুষকে দায়মোচনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছেন যার পরিণতি কষ্টভোগের নিয়তি।
মানুষের জীবনে সুখ আনতে ইনকুইজিটর ও চার্চ এভাবে “জ্ঞানীর আত্মা, মৃত্যু ও ধ্বংসের ভয়ঙ্কর আত্মা” অনুসরণ করে, এর মানে, এ হল সেই শয়তান যে একাই সমস্ত মানবিক দুর্দশার অবসান ঘটাতে যাবতীয় সরঞ্জাম সরবরাহ করতে পারে এবং পারে চার্চের ব্যানারে সবাইকে একত্রিত করতে। জনমানুষ এমন কয়েকজনের দ্বারা চালিত হওয়া উচিত যারা শুধ অজ্ঞতায় সমস্ত মানবজাতির সুখ নিয়ে বাঁচা-মরার স্বাধীনতার বোঝা বহন করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী। এই কয়েকজন হলেন সত্যিকারের আত্মশহীদ যারা মানবতাকে পছন্দ-অপছন্দের দায় থেকে মুক্তি দিতে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। সেজন্যই পাথরকে রুটিতে রূপান্তরিত করার শয়তানের প্রলোভন প্রত্যাখ্যান করে যীশুখ্রীষ্ট ভুল করেছিলেনঃ যে তাদের পেটের ক্ষুধা মিটাবে মানুষ সবসময় তাকেই অনুসরণ করে। যীশুখ্রীষ্ট এই প্রলোভনটি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এই বলে যে, “মানুষ কেবল রুটির উপরেই বাঁচতে পারে না” আর উপেক্ষা করে সেই জ্ঞানকেঃ “মানুষের পেটের ক্ষুধা মিটাও, এবং তারপর তাঁদের পুণ্যের কথা জিজ্ঞাসা করো!” ইনকুইজিটরকে জবাব না দিয়ে এতক্ষণ চুপ থাকা যীশুখ্রীষ্ট তাকে ঠোঁটে চুম্বন করলেন; হতবাক হয়ে ইনকুইজিটর যীশুখ্রীষ্টকে ছেড়ে দিল কিন্তু আর ফিরে আসতে নিষেধ করলো … আলিউশা যীশুখ্রীষ্ট অঙ্গভঙ্গিটি পুনরাবৃত্তি করে সেই গল্পটির প্রতিক্রিয়া জানায়ঃ সে-ও ইভানের ঠোঁটে নরম একটি চুম্বন দেয়।
গল্পটির মূল বক্তব্য কেবল চার্চকে আক্রমণ করা নয় এবং নয় পূর্ণ স্বাধীনতায় ফিরিয়ে দিতে যীশুখ্রীষ্টের ফিরে আসার পক্ষে ওকালতি করা। দস্তয়ভস্কি নিজেও সরাসরি এর উত্তর কি হবে তা দিতে পারেননি। আমাদের মনে রাখা উচিত যে গ্র্যান্ড ইনকুইজিটরের নীতিগর্ভ রূপকটি একটি বৃহত্তর তার্কিক প্রসঙ্গের অংশ যার শুরু ঈশ্বরের নিষ্ঠুরতা এবং মানুষের দুর্দশার প্রতি উদাসীনতার ভিতর দিয়ে; যবের বইয়ের [The book of Job] (৯.২২২৪) নির্দেশ করে ইভান তাই আহ্বান করেছেঃ
“তিনি নির্দোষ ও দুষ্ট লোকদের বিনাশ করেন। যদি হঠাৎ আঘাতে মৃত্যু হয়, নিরপরাধের হতাশাকে তিনি বিদ্রূপ করেন। পৃথিবী দুষ্টের হাতে দেয়া হয়েছে; তিনি তার বিচারকদের মুখ ঢেকে রাখেন। যদি তিনি না-হন তবে কে সে?”
আলিউশার পাল্টাযুক্তি হলো কষ্টভোগের প্রশ্নটির উত্তর কেন কেবলমাত্র ঈশ্বর-পিতার কাছ থেকে পাওয়া যায় না ইভান শুধু তা দেখিয়েছে। কিন্তু আমরাতো ইহুদি বা মুসলমান নই, আমাদের আছে ঈশ্বর পুত্র, আলিউশা যোগ করে, এবং তাই ইভানের যুক্তি নিছক ঈশ্বরবাদী বিশ্বাসের বিপরীতে খ্রিস্টানদের আরো শক্তিশালী করেঃ যীশুখ্রীষ্ট “সবকিছু ক্ষমা করতে পারেন, সবকিছুই এবং সবকিছুর জন্য, কারণ তিনি সব কিছুর জন্য তাঁর নিরীহ রক্ত দিয়েছেন।” এ হল যীশুখ্রীষ্টের পিতা থেকে পুত্রে পরিণত হবার প্রেক্ষিতে ইভানের উত্তর; ইভান গ্রেট ইনকুজিটরের নীতিগর্ভ রূপক হিসাবে এটিকে উপস্থাপন করেছে, এবং যদিও সরাসরি এর কোনো উত্তর নাই, তবুও কেউ দাবি করতে পারে যে, এর অন্তর্নিহিত সমাধান হ’ল পবিত্র আত্মা (Holy Spirit): “সকলের জন্য এবং প্রত্যেকের জন্য প্রত্যেকের বৈপ্লবিক সমতাবাদী দায়িত্ব।”
কেউ এমনও যুক্তি দিতে পারেন যে, গ্র্যান্ড ইনকুইজিটরের অধ্যায়টির ঠিক পরের অধ্যায়ে এল্ডার জোসিমার জীবন হলো ইভানের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়াস। মৃত্যু শয্যায় থাকা জোসিমা বলে তিনি কিভাবে তাঁর বিদ্রোহ-প্রবণ যৌবনে দ্বন্দ্বের মাঝে বিশ্বাস খুঁজে পেয়েছিলেন এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সন্ন্যাসী (monk) হবার। জোসিমা শিখিয়েছেন যে, মানুষের অবশ্যই নিজের পাপ এবং দোষ অন্যের সামনে স্বীকার করে অন্যকে ক্ষমা করতে হবেঃ কোনো পাপই বিচ্ছিন্ন নয়, তাই প্রত্যেকেই তার প্রতিবেশীর পাপের জন্য দায়ী।
“যদি ঈশ্বর না থাকে, তাহলে সবকিছু নিষিদ্ধ” এই কথা কি দস্তয়ভস্কির সংস্করণ নয়? যীশুখ্রীষ্ট্রের উপহার যদি হয় আমাদের মৌলিকভাবে স্বাধীন করা তবে এই স্বাধীনতাও পরিপূর্ণ দায়বদ্ধতার ভারী বোঝা নিয়ে আসে।
(এবিসি ধর্ম ও নীতি, ১৭ এপ্রিল, ২০১২ এ প্রকাশিত। সংগ্রহঃ https://www.abc.net.au/religion/if-there-is-a-god-then-anything-is-permitted/10100616)