প্রযুক্তিগত পুনরুৎপাদনযোগ্যতার যুগে শিল্পকলার ভূমিকা (পর্ব ৬) / ওয়াল্টার বেনিয়ামিন

শিল্পকর্মের গ্রহণীয়তা তার চরিত্রের সাথে পরিবর্তিত হয়, তবে সাধারণভাবে দুটি পুরাপুরি বিপরীত ধরণ এক্ষেত্রে বিদ্যমানঃ একটি শিল্পকর্মের কাল্ট মূল্যের উপর জোর দেয়; অন্যটি জোর দেয় এর প্রদর্শনী মূল্যের।১৫ শৈল্পিক উৎপাদন শুরু হয় কাল্ট সেবার জন্য প্রতিমা দিয়ে। কেউ ধরে নিতে পারেন যে এই প্রতিমাগুলিকে দেখার চেয়ে তাদের আসল চেহারা নিয়ে হাজির হওয়া আরো গুরুত্বপূর্ণ। পাথর যুগের মানুষটি তার গুহার দেয়ালে যে হরিণবিশেষ চিত্র তুলে ধরেছিল তা ম্যাজিকের একটি উপকরণ। নিশ্চিত হতে সে এটি তার সহকর্মীদের কাছে প্রদর্শন করেছে, তবে উদ্দেশ্য ছিল তার আত্মার ভিতরকার কোনও এক অর্থ বোঝানো। মনে হয় কাল্ট মূল্য আজকাল শিল্পকর্মকে চোখের আড়ালে রাখতে চায়ঃ দেবতার কিছু মূর্তি কেবলমাত্র পুরোহিতদের জন্য অবারিত; ম্যাডোনার কিছু চিত্র প্রায় সারা বছর জুড়ে আচ্ছাদিত থাকে; মধ্যযুগীয় ক্যাথেড্রালগুলির কিছু ভাস্কর্য দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত নয়। শাস্ত্রীয় আচারের থেকে সুনির্দিষ্ট শৈল্পিক অনুশীলনের বিচ্ছেদের সাথে সাথে তাদের উৎপাদনগুলির প্রদর্শনের সুযোগ বাড়তে থাকে। কোনও মন্দিরের ভিতরে স্থায়ী জায়গায় রাখা দেবমূর্তি প্রদর্শনের চেয়ে যেখানে-সেখানে পাঠানো যেতে পারে এমন প্রতিকৃতির প্রদর্শন করা বেশী সহজ। মোজাইক বা ফ্রেস্কো যা আগে এসেছে তার চেয়ে প্যানেল পেইন্টিং আরও সহজে প্রদর্শিত হতে পারে। এবং যদিও সম্ভবত জনসাধারণের জন্য উন্মুক্তভাবে সিম্ফনির উপস্থাপন কম উপযোগী হওয়ার কারণ ছিল না তবুও সিম্ফনির সবার কাছে হাজির হল যখন এই জাতীয় উপস্থাপনের সম্ভাবনা আরও বেশি হওয়ার আশ্বাস পেয়েছিল।

প্রযুক্তিগতভাবে পুনরুৎপাদনের বিভিন্ন পদ্ধতির সাথে শিল্পকর্ম প্রদর্শনের সুযোগ এত বেশি বেড়েছে যে, যেমন প্রাগৈতিহাসিক যুগে ঘটেছিল, শিল্পকর্মের দুই মেরুর মধ্যে একটি পরিমাণগত পরিবর্তন তার প্রকৃতির মধ্যে একটি গুণগত পরিবর্তনের দিকে চালিত করেছে। যেমন তার কাল্ট মূল্যের নিরঙ্কুশ গুরুত্ব নিয়ে প্রাগৈতিহাসিক সময়ে শিল্পকর্ম প্রথম এবং সবচেয়ে আগে যাদুবিদ্যার একটি সরঞ্জাম হয়ে উঠেছে, যা কেবল পরে শিল্পকর্ম হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে, তেমনি আজ শিল্পকর্ম পুরাপুরি প্রদর্শনীর মূল্যের গুরুত্বের উপর জোর দিয়ে বেশ কিছু নতুন ক্রিয়াকলাপসহ একটি নির্মাণ [Gebilde] হয়ে উঠেছে। এগুলির মধ্যে যে শৈল্পিক ক্রিয়াকলাপ আমরা সচেতন সেগুলিই পরবর্তীকালে প্রাসঙ্গিক হয়ে হয়েছে।১৬ এটি অনেকটাই নিশ্চিতঃ আজ ফটোগ্রাফি এবং চলচ্চিত্রই আমাদের নতুন বোঝাপড়ার সবচেয়ে কার্যকর বাহন।

টীকাঃ

১৫. আদর্শের নন্দনতত্ব যা সৌন্দর্যকে মৌলিকভাবে অবিভক্ত হিসাবে বিবেচনা করে (এবং এভাবে যা কিছু মেরুকরণের শিকার হয় তা বাদ দেয়) এই মেরুকরণ তার নিজের মধ্যে বয়ে আনতে পারে না। তবুও হেগেল আদর্শবাদের সীমাবদ্ধতার মধ্যে যথাসম্ভব স্পষ্টভাবে এই মেরুকরণ ঘোষণা করেছেন। আমরা তাঁর ‘ইতিহাসের দর্শনের উপর বক্তৃতা’ থেকে উদ্ধৃতি দিতে পারি “চিত্রগুলি প্রাচীন হিসাবে আমাদের জানা। সেই প্রাচীন যুগে উপাসনার জন্য ধার্মিকতা প্রয়োজন ছিল, তবে সুন্দর চিত্র ছাড়াও তা করা যেত। এই জাতীয় চিত্রগুলি এমনকি হয়ত অনেক গোলমেলে ছিল। প্রতিটি সুন্দর চিত্রে ছিল বাহ্যিক এমন কিছু – যদিও সুন্দর হিসাবে সে চিত্রের আত্মা তখনও মানবজাতির সাথে কথা বলেছে। তবে ধর্মীয় উপাসনা আত্মার আত্মাহীন বোধহীনতা ছাড়া বেশী কিছু নয়, যা চালিত হয়েছে একটি উদ্দেশ্যে … চারুকলার উত্থান ঘটেছে … চার্চে … যদিও শিল্পকলা এখন যাজকীয় নীতি ছাড়িয়ে গেছে।” একইভাবে, ‘নন্দনতত্ত্বের উপর বক্তৃতার’ এক জায়গায় উদ্ধৃতি দিতে পারি যেখানে হেগেল একটি সমস্যা আন্দাজ করেছিলেনঃ “আমরা ঐশ্বরিক এবং আমাদের উপাসনার উপযুক্ত বস্তুরূপে শিল্পকর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের যে পর্যায় তার বাইরে। আজ তারা যে অনুভব জাগায় তা অনেকটা প্রতিফলন ঘরানার, এবং তারা যে আবেগ জাগিয়ে তোলে তার আরও কঠোর নিরীক্ষা প্রয়োজন।” প্রথম ধরণের শৈল্পিক গ্রহণীয়তা থেকে দ্বিতীয়টিতে রূপান্তর সাধারণভাবে শৈল্পিক গ্রহণীয়তার ইতিহাসকে সংজ্ঞায়িত করে। তা ছাড়াও, গ্রহণীয়তার পদ্ধতির এই দুটি মেরুর মধ্যে একটি নির্দিষ্ট দোলাচাল প্রতিটি শিল্পকর্মের প্রদর্শিত হতে পারে। ধরুন সিস্টাইন ম্যাডোনার কথা। হুবার্ট গ্রীম্ম দেখিয়েছেন যে ম্যাডোনাকে মূলত প্রদর্শনীর জন্য আঁকা হয়েছিল। তাঁর গবেষণা যে প্রশ্নটি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল তা হলঃ চিত্রাঙ্কনের সম্মুখভাগে ছাঁচনির্মাণের উদ্দেশ্য কী যেখানে দুটি কিউপিড সামনের দিকে ঝুঁকে রয়েছে? এবং গ্রীম্মের আরও জিজ্ঞাসা হল, রাফায়েল কেন দুটি ঝালর দিয়ে আকাশকে সাজিয়েছেন? গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে পোপ সিক্সটাস-এর রাজ্যে জনসাধারণের জন্য ম্যাডোনার অনুমোদন দিয়েছিলেন। ঐতিহ্যগতভাবে পোপদের অবস্থান ছিল সেন্ট পিটার্স চ্যাপেলের একটি নির্দিষ্ট অংশে। সেই উপলক্ষে রাফায়েলের চিত্রটি চ্যাপেলের পিছনের দিকে কুলুঙ্গির মতো জায়গায় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল কফিনের ঠিক উপরে। এই চিত্রে রাফায়েল কুলুঙ্গির পিছন থেকে পোপীয় কফিনের কাছে মেঘে ভেসে আসছে তেমনভাবে ম্যাডোনাকে চিত্রিত করেছেন যা তিনি সবুজ ঝালর দিয়ে ফ্রেমবন্দী করেছেন। পোপ সিক্সটাসের শেষকৃত্যের আনুষ্ঠানিকতাকে এভাবে রাফায়েলের ছবির একটি প্রাথমিক প্রদর্শনী মূল্য হিসাবে গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছিল। চিত্রকর্মটি পরে পিয়াসেঞ্জার চার্চ অফ দ্য ব্ল্যাক ফ্রিয়ার্সের উঁচু বেদিতে স্থানান্তরিত হয়। চিত্রকর্মের এই নির্বাসনটি রোমান ক্যাথলিক মতবাদের ফল ছিল, এর ফলে শেষকৃত্যের জন্য প্রদর্শিত চিত্রগুলি উচ্চ বেদীর উপাসনার উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করা যাবে না – এমন সিদ্ধান্তকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই নীতির অর্থ হল রাফায়েলের চিত্রটির মানকে খাটো করা; তবে চিত্রকর্মের সন্তোষজনক মান ধরে রাখার জন্য পোপীয় দৃষ্টি উচ্চবেদীর উপরে চিত্রটি নীরবে মেনে নিয়ে খরিদ্দারের চাহিদাকে সহজলভ্য করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অযথা দৃষ্টি আকর্ষণ না করার খাতিরে চিত্রটি সেই দূরের প্রাদেশিক শহরের সন্ন্যাসীদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল। [বেনিয়ামিনের নোট। জার্মান ভাববাদী দার্শনিক জর্জ উইলহেলম ফ্রেডরিক হেগেল (১৭৭০ – ১৮৩১) বার্লিনে ১৮১৮ সালে দর্শনের চেয়ার পদটি গ্রহণ করেছিলেন। নন্দনতত্ত্ব এবং ইতিহাসের দর্শন নিয়ে তাঁর বক্তৃতাগুলি (১৮২০ – ১৮২৯) পরবর্তীকালে তাঁর সম্পাদকরা প্রকাশ করেছিলেন। মূল পাঠটি তাঁর ছাত্রদের থেকে নোটের উপর ভিত্তি করে রচিত। ইতালিয়ান চিত্রশিল্পী এবং স্থপতি রাফায়েল সান্তি (১৪৮৩ – ১৫২০) সিসটিন ম্যাডোনা এঁকেছিলেন ১৫১৩ সালে; এটি এখন ড্রেসডেনে ঝুলছে। হুবার্ট গ্রীম্মে, “Das Riitsel der Sixtinischen Madonna” (সিসটিন ম্যাডোনার রহস্য), Zeitschrift fur bildende Kunst, ৫৭ [নতুন সিরিজের ৩৩] (১৯২২), পৃষ্ঠা ৪১ – ৪৯. অনুদিত]

১৬. বার্টল্ট ব্রেখট ভিন্নভাবে একই রকম চিন্তার প্রতিফলন দেখিয়েছেনঃ “যদি ‘শিল্পকর্মের’ ধারণা বস্তুর উপর প্রয়োগ করা যায় না যখন একবার বস্তুকে পণ্য হিসাবে রূপান্তরিত করা হয়, তখন আমাদের এই ধারণাটি যথাযথ সতর্কতার সাথে তবে ভীতি ছাড়াই নির্মূল করতে হবে, পাছে আমরা সে বস্তুরই চরিত্র নিঃশেষ কয়রে ফেলি। কারণ তাকে অবিচলভাবে এই পর্যায় অতিক্রম করে যেতে হবে; এছাড়া আর কোনো সরল পথ; বরং এখানে শিল্পকর্ম নিয়ে যা ঘটে তা তাকে মৌলিকভাবে পরিবর্তন করে ফেলবে, তার অতীতকে এমনভাবে মুছে ফেলবে যে পুরাতন ধারণাটি আবার গৃহীত হয়ে যাবে (এবং তা- ই হবে; কেন হবে না?) – তা যে জন্য এক সময়ে সে খ্যাত হয়েছিল সে স্মৃতি আর আমাদের তাড়িত করবে না।” ব্রেখট, Versuche (নিরীক্ষা), ৮ – ১০, নং ৩ (বার্লিন, ১৯৩১), পৃষ্ঠা ৩০১ – ৩০২ (“Der Dreigroschenprozess” [তিন পয়সার বিচার])। [বেনিয়ামিনের নোট। জার্মান কবি ও নাট্যকার বার্টল্ট বা বার্ট (ইউজেন বার্থল্ড ফ্রেডরিখ) ব্রেখট (১৮৯৮ – ১৯৫৬) ছিলেন Die Dreigroschenoper (তিন পয়সার বিচার; ১৯২৮) এর লেখক, সংগীত কার্ট ওয়েল, Mutter Courage und ihre Kinder (মায়ের সাহস ও তাঁর শিশুদের, ১৯৪১), এবং Der kaukasische Kreidekreis (ককেশিয়ান চক সার্কেল; ১৯৪৮)। ব্রেখটের সাথে বেনিয়ামিন বন্ধুত্ব হয়েছিল ১৯২৯ সালে এবং তিরিশের দশকে রাজনীতি এবং শিল্পের বিষয়ে তাঁর চিন্তাভাবনার যথেষ্ট প্রভাব ছিল।
লেখার এই পর্যায়ে বেনিয়ামিন প্রথম এবং দ্বিতীয় প্রযুক্তির মধ্যে পার্থক্য নিয়ে দুটি অনুচ্ছেদে তাড়িত হয়েছিলেন। দেখুন “প্রযুক্তিগত পুনরুৎপাদনযোগ্যতার যুগে শিল্পকলার ভূমিকা” এর দ্বিতীয় সংস্করণটি, নির্বাচিত রচনাবলী, খণ্ড ৩ঃ ১৯৩৫ -১৯৩৮ (কেমব্রিজ, ম্যাসাচুসেটসঃ হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০২), পৃষ্ঠা ১০৭ -১০৮ -অনুদিত]

Leave a Reply

আপনি এখান থেকে কপি করতে পারবেন না!