প্রায়ই এমনটা ঘটে যখন বনের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ আমরা চমকে উঠি বিভিন্ন রকমের প্রাণীর না-শোনা কণ্ঠস্বরেঃ কাঁপা কাঁপা শব্দ, ভোঁ ভো এবং গড়গড় কলকল ধ্বনি; কাঠ বা লোহার চটার চড়া ধ্বনি; পাখীর কিচিরমিচির, শোঁ শোঁ এবং ফিসফিসঃ হঠাৎ চমকে দেয়া প্রতিটি প্রাণীর নিজস্ব কণ্ঠস্বর। শেষমেষ, কোকিলের দ্বৈত সুরধ্বনি আমাদের নীরবতাকে উপহাস করে এবং বিভিন্ন প্রাণীর কণ্ঠের সীমাহীন ঐকতানের মাঝে আমাদের অনন্য, বাকহীন সত্ত্বার অগ্রহনীয়তা উন্মোচিত হয়। তখনই কেবল আমরা কথা বলার, চিন্তা করার চেষ্টা করি।
আমাদের জিহ্বায় চিন্তা শব্দটি মূলত মানসিক পীড়ন, তীব্র উদ্বেগের অর্থ বহন করে, যেমনটি এখনও চিন্তাশীলতা, উদ্বেগ “stare in pensiero” এই পরিচিত অভিব্যক্তির মধ্যে পাওয়া যায়। ল্যাটিন ক্রিয়াপদ pendere যার অর্থ “স্থগিত” সেখান থেকে রোমান ভাষায় শব্দটি এসেছে। সেন্ট অগাস্টিন শেখার প্রক্রিয়ার বিশিষ্টতা বোঝাতে শব্দটি ব্যবহার করেছেন এই অর্থেঃ “সাধকের অন্বেষার অন্তর্নিহিত আকাঙ্ক্ষা এবং যা কোনো একভাবে স্থগিত [pendet quodammodo] তা সাধনার যে পরিনতি তাতেই শেষ হয়ে যায় না, বরং তা সাধক ও সাধনার লক্ষ্যবস্তু একে অপরকে পেয়ে যখন একাকার হয়ে যায়।” কি সে-ই যা স্থগিত, যা চিন্তায় “ভেসে” থাকে? আমরা চিন্তা করি একমাত্র ভাষায়, কারণ ভাষা আমাদের কণ্ঠস্বর এবং কণ্ঠস্বর নয়। ভাষার মধ্যে রয়েছে একটি অপেক্ষারত, অমীমাংসিত প্রশ্ন, এবং তা হ’ল ভাষা কি আমাদের কণ্ঠস্বর বা কণ্ঠস্বর নয়, যেভাবে গাধার ডাক গাধার কন্ঠস্বর এবং ঝিঁঝি ঝিঁঝিপোকার। এই কারণেই, যখন আমরা কথা বলি, আমরা চিন্তা ছাড়া কথা বলতে পারি না, শব্দগুলো স্থগিত না-করে কথা বলতে পারি না। চিন্তা ভাষার মধ্যে আমাদের কণ্ঠস্বরকে স্থগিত করে হাজির থাকে।
(স্পষ্টতই ঝিঁঝিপোকা যখন ঝিঁঝি করে তখন চিন্তা করতে পারে না)
সন্ধ্যায় যখন আমরা বনের ভিতর দিয়ে হেঁটে যাই তখন প্রতিটি পদক্ষেপে ঝোঁপঝাঁড়ের মাঝে অদৃশ্য পশুর খচমচে গতিবিধি বুঝতে পারি, যদিও আমরা জানি না ওরা গিরগিটি, শজারু, খোঁচা নাকি সাপ। ঠিক তেমনটিই ঘটে যখন আমরা চিন্তা করিঃ শব্দের সঙ্গী হয়ে আমরা যে পথে ঘুরে বেড়াই সে পথ নয়, বরং প্রান্তে এসে মাঝে মাঝে যখন পলায়নরত কোন প্রাণীর অস্পষ্ট পদচারনা শুনি বা আমাদের নিজেদের পদধ্বনির শব্দে আচমকা জেগে উঠি – সে পথে।
আমাদের বলা হয়েছে, পলায়নরত প্রাণী, পলায়নরত মর্মরধ্বনি আমরা অনুভব করি তা-ই হলো আমাদের কণ্ঠস্বর। আমরা চিন্তা করি – আমরা শব্দগুলিকে স্থগিত করি এবং নিজেদেরকে ভাষায় বিলম্বিত করি – আমরা চিন্তা করি কারণ শেষমেষ আমরা সেখানে ভাষার মধ্যে কণ্ঠস্বর খুঁজে পাবার আশা করি। আমাদের বলা হয়েছে, আমাদের কণ্ঠস্বর নিজেকে ভাষায় লিখে ফেলেছে। ভাষায় কণ্ঠেস্বরের খোঁজই হলো চিন্তা।
সেই ভাষা আমাদের বিস্মিত করে এবং সবসময় প্রতীক্ষায় থাকে কণ্ঠস্বরের; ভাষায় কণ্ঠস্বরের মুলতবির কোনো শেষ নাইঃ দর্শনের ক্ষেত্রে এটাই সমস্যা। (প্রত্যেকে কিভাবে এই পক্ষপাতের সমাধান করে তা-ই নৈতিকতা)
কিন্তু কণ্ঠস্বর, মানুষের কণ্ঠস্বর তা করে নাঃ আমাদের কণ্ঠস্বর ব’লে এমন কিছু নাই যা আমরা ভাষার পদচিহ্নে অনুসরণ করতে পারি, মনে রাখার মত করে জড়ো করতে পারি – যে মুহুর্তে কণ্ঠস্বর সংজ্ঞায় বিলুপ্ত হয়ে যায়, সেই মুহুর্তে সে নিজেকেই লিপিবদ্ধ করে বর্নমালায়। আমরা কথা বলি সেই কণ্ঠস্বরে যা আমাদের নাই, সেই কণ্ঠস্বর কখনও লিখিত হয়নি (অ্যান্টিগোন, ৪৫৪)। এবং ভাষা সবসময়ই “মৃত বর্নমালার” মতো।
চিন্তাঃ আমরা কেবল তখনই চিন্তা করতে পারি যখন ভাষা আমাদের কণ্ঠস্বর নয়, কেবল তখনই যখন আমরা বাকহীনতার তলদেশ অনুধাবন করি। তবে সত্য হলো, এর কোন তলদেশ নাই। এমন অতল গহ্বরই হলো আমাদের ভুবন।
যুক্তি বলে যে, ভাষা আমার কণ্ঠস্বর নয়। আরও বলছে যে, যে কণ্ঠস্বরটি উচ্চারিত হয়ে গেছে, এখন তা আর নাই, আবার কখনো উচ্চারিত হতে পারবে না। ভাষা স্থান কণ্ঠের অ-স্থানে। যার অর্থ হ’ল কণ্ঠস্বর সম্পর্কে চিন্তার কিছু বলার নাই। এটিকে আমরা ভক্তি বলতে পারি।
সুতরাং ভাষায় কণ্ঠের পলায়ন, মুলতুবি শেষ হওয়া উচিত। আমরা অবশেষে স্থগিত অবস্থায় ভাষা এবং কণ্ঠস্বর ধরে রাখা নিবৃত করতে পারি। কণ্ঠস্বর যদি কখনো না-হয়ে থাকে, চিন্তা যদি কণ্ঠের চিন্তা করে থাকে তবে কি নিয়ে চিন্তা তার তার কোনো অস্তিত্বই নাই। যে চিন্তা পরিপূর্ণ, তার চিন্তা করার কোনো চিন্তাই আর অবশিষ্ট নাই।
লাতিন ক্রিয়াপদ, cogitare, বহু শতাব্দী ধরে যার অর্থ ‘চিন্তা করা’ তা যে tracotanza, ঔদ্ধত্য, দম্ভ নিয়ে চিহ্নিত হয়ে আছে আমাদের ভাষায় এমনটি খুঁজে পাওয়া বিরল। পঞ্চদশ শতকে, coto, cuitanza মানে ছিলঃ চিন্তা। লাতিন ultracogitare শব্দ থেকে উদ্ভূত এবং ফ্রান্সের প্রঁভাস-প্রদেশের ভাষায় oltracuidansa থেকে পরিবর্তিত হয়ে আসা Tracotanza stems শব্দের মানে হলঃ অতিক্রম করে যাওয়া, চিন্তার সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া, অত্যধিক চিন্তা (overthinking), অপ-চিন্তা (dis-thinking)।
যা বলা হয়েছে তা আবার বলা যেতে পারে। তবে যে চিন্তা একবার করা হয়ে গেছে তা আর কখনও বলা যায় না। চিন্তার শব্দ চিরতরে ছেড়ে চলে যায়।
আমরা বনের মধ্য দিয়ে হাঁটছি; হঠাৎ শুনি ডানার ঝাপটানোর বা ঘাস নড়ে ওঠার শব্দ। একটি রঙ্গিন পাখি উড়ে গাছের ডালে কখন যে অদৃশ্য হয়ে গেলো বুঝতেই পারিনি, একটা শজারু ঝোঁপের গভীরে লুকিয়ে গেলো, সাপের চলার পথে শুকনো পাতারা মচমচ করে উঠলো। চিন্তা মানে অদৃশ্য প্রাণীর মুখোমুখি হওয়া নয় বরং তার সাথে লড়াইয়ে নামা। না, তা আমাদের কণ্ঠস্বর ছিলো নাঃ আমরা যতটা সম্ভব ভাষার কাছাকাছি এসেছি, আমরা ভাষাকে ভাসিয়ে দিয়েছি, প্রায় স্থগিত করেছিঃ তবে আমাদের সাথে ভাষার দেখা হয়নি, এবং আমাদের এখন অবশ্যই ফিরে যেতে হবে বাড়ি দিকে চিন্তাহীন।
তারপর ভাষা আমাদের কণ্ঠস্বর, আমাদের ভাষাতে পরিণত হল। আপনি এখন যেভাবে কথা বলছেন, তাকেই আমরা নৈতিকতা বলি।
[রচনাকালঃ ১৯৮৬। DIFFERENTIA: Review of Italian Thought, No. 1, Autumn, 1986 এ প্রকাশিত। পিটার কারাভেটার ইংরাজি অনুবাদ থেকে বাংলায় ভাষান্তরিত]