‘লন্ডন রিভিউ অব বুকস’ -এ ২৮ জুন ২০১৩ তারিখে প্রকাশিত
তাঁর প্রথম দিকের লেখায় মার্কস শুধুমাত্র বিশেষ সমস্যার সার্বজনীন সমাধান হিসাবে জার্মান পরিস্থিতির প্রসঙ্গ টেনে বলেছিলেনঃ বিশ্ব-জোড়া বিপ্লব। এটি সংস্কারবাদী ও বিপ্লবী সময়ের মধ্যে পার্থক্যের একটি সংক্ষিপ্ত অভিব্যক্তি মাত্রঃ একটি সংস্কারবাদী সময়ের মধ্যে, আন্তর্জাতিক বিপ্লব একটি কল্পনা মাত্র, কেবল স্থানীয়ভাবে ব্যাপার পরিবর্তন করার প্রচেষ্টা; একটি বিপ্লবী সময়ের মধ্যে, এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে ভিত্তিগত বৈশ্বিক পরিবর্তন ছাড়াই উন্নতি সম্ভব নয়। শুদ্ধরূপ প্রথাগত অর্থে, ১৯৯০ ছিল একটি বিপ্লবী বছরঃ এটি পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের আংশিক সংস্কার করে কর্ম সাবাড় হবার নয়, এবং মানুষের খেয়ে-পরে থাকার জন্য নূ্যনতম প্রয়োজন মিটাবার মত দৈনন্দিন সমস্যার সমাধানের জন্য বড় ভাঙ্গনের দরকার ছিল।
আমরা আজ এই বিভেদের কোথায় দাঁড়িয়ে আছি? গত কয়েক বছরের সমস্যা ও উদ্ভুত প্রতিবাদ কি আগত বিশ্বব্যাপী সঙ্কটের আভাস, নাকি শুধুমাত্র ছোটখাট বাঁধা যা স্থানীয় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে মোকাবিলা করা যেতে পারে? এই জাগরণ নিয়ে সবচেয়ে অসাধারণ ব্যাপার হল যে এসব ঘটছে শুধুমাত্র প্রাথমিকভাবে কাঠামোর দুর্বলতম মুহূর্তে, এমনকি এমন এমন স্থানে যারা এতকাল সাফল্যের উদাহরন হিসাবে সাক্ষ্য পেয়ে আসছিল। মানুষ গ্রীস বা স্পেনে কেন প্রতিবাদ করছে তা আমরা জানি; কিন্তু কেন তুরস্ক, সুইডেন বা ব্রাজিলের মত সমৃদ্ধশালী বা দ্রুত উন্নয়নশীল দেশে ঘটছে? ইতিহাসের ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে এমন বোধোদয় হয় যে, ১৯৭৯ সালে খোমেনীর বিপ্লব হতে পারত মূল ‘জান্নাতে সমস্যা’ যদি তা হতো পশ্চিমী আধুনিকায়নের প্রক্রিয়ার প্রথম সারিতে থাকা একটি দেশ যে কিনা ঐ অঞ্চলে পশ্চিমের স্বার্থ রক্ষাকারী হতো। সম্ভবত জান্নাতের ধারণা সম্পর্কে আমরা কোথাও ভুল করছি।
বর্তমানের এই প্রতিবাদের ঢেউ উঠার আগে, তুরস্ক ছিল সবার কাছে সরগরমঃ মধ্যপন্থী ইসলামবাদিতার সঙ্গে সমৃদ্ধ উদারবাদী অর্থনীতির সমন্বয়ে একটি রাষ্ট্রীয় মডেল, ইউরোপীয় ব্যবস্থার উপযুক্ত, আরো বেশী ‘ইউরোপীয়’ বলে পরিচিত গ্রীসের সাক্ষাত বৈপরীত্বের প্রমান; কিন্তু এখন আটকে গেছে মতাদর্শিক জটিলতায়, এবং অর্থনৈতিকভাবে আত্মধ্বংসী প্রক্রিয়ায়। সত্য যে, কিছু কিছু সমস্যা অনেক কাল ধরেই বিদ্যমান (আর্মেনিয়দের ব্যাপক হত্যাকাণ্ড বিষয়ে তুরস্কের অস্বীকৃতি, সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার, কুর্দ নিয়ে অমীমাংসিত অবস্থা, অটোমান সাম্রাজ্যের ঐতিহ্য পুনরুত্থানের মাধ্যমে বৃহত্তর তুরস্কের আহ্বান, অনিয়মিতভাবে ধর্মীয় আইনের আরোপ), কিন্তু এসব কিছুই ছোটখাট সমস্যা হিসাবে উপেক্ষিত ছিল যা কিনা সামগ্রিক চিত্রের উপর কোন প্রকার দাগ কাটতে পারবে না বলেই মনে করা হতো।
তারপর তাকসিম স্কয়ারে প্রতিবাদ বিক্ষোভে বিস্ফোরিত হয়। সবাই জানে যে ইস্তানবুলের কেন্দ্রে তাকসিম স্কয়ারকে ঘিরে একটি শপিং সেন্টার নির্মানের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে ‘সত্যিকার অর্থে’ এই বিক্ষোভ ছিল না, বরং বিরাজমান অনেক গভীর অস্বস্তি এই বিক্ষোভের শক্তি যুগিয়ে যাচ্ছিল। একইভাবে জুন মাসের মাঝামাঝি ব্রাজিলেও বিক্ষোভ জেগে উঠেছিলঃ পাবলিক ট্রান্সপোর্টের ভাড়া স্বল্প বৃদ্ধির প্রতিবাদে সৃষ্টি হয় আন্দোলন, কিন্তু তা প্রত্যাহার করে নেয়া হলেও বিক্ষোভ চলতে থাকে। এই বিক্ষোভ এমন একটি দেশে ছড়িয়ে পড়ল যার, অন্তত মিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় ছিল এবং ভবিষ্যত সম্পর্কে সন্দিহান হবার মত কোনো কারণ ছিল না। প্রেসিডেন্ট দিলমা রউসেফ দৃশ্যত নিজেও আনন্দিত হয়ে এই আন্দোলনে সমর্থন ঘোষণা করেন।
এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, তুরস্কের এই প্রতিবাদকে আমারা নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দ্বারা সমর্থিত একনায়কতন্ত্রী ইসলামী শাসকদের বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষ সুশীল সমাজের প্রতিবাদ হিসাবে দেখি না। যে বিষয়টি এই অবস্থাকে আরো জটিল করে তোলে তাহল এই বিক্ষোভের ‘পুঁজিবাদী বিরোধী অবস্থান’ যা প্রতিবাদকারীরা সহজভাবে বোঝে যে মুক্ত বাজার মৌলবাদ ও মৌলবাদী ইসলামের পারস্পরিক সম্পর্ক গাঁটছাড়া নয়। একটি ইসলামী সরকার কর্তৃক জনগনের জন্য মুক্ত স্থান বেসরকারীকরণের উদ্যোগ প্রমান করে যে, এই দুই ধরণের মৌলবাদ হাতে হাত রেখে কাজ করতে পারেঃ ‘শ্বাশত’ গণতন্ত্র আর পুঁজিবাদের বিবাহবিচ্ছেদ যে আসন্ন এটা তারই প্রতীক।
এটাও বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে, প্রতিবাদকারী কোনো চিহ্নিত ‘বাস্তব’ লক্ষ্য অনুসরন করছে না। এই প্রতিবাদ ‘সত্যিই’ বিশ্ব পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে নয়, ‘সত্যিই’ ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে নয়, ‘সত্যিই’ নাগরিক স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের জন্য নয়, বা ‘সত্যিই’ কোনো সুনির্দিষ্ট বিশেষ কিছুর জন্য নয়। প্রতিবাদে অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই এক ধরণের ও অতৃপ্তির বশে একত্রিত এবং ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির ভিন্ন ভিন্ন সুনির্দিষ্ট চাহিদা তাদের এক গ্রন্থিতে বেঁধেছে। সাংবাদিক বা তাত্ত্বিকরা যারা এই বিক্ষোভের সত্যিকার বিশয়-আশয় ব্যাখ্যা করতে চাইছেন তাদের জন্য বিক্ষোভ বা প্রতিবাদকে বোঝার ব্যাপারটা শুধুমাত্র জ্ঞানতাত্ত্বিক সমস্যাই নয়, বিক্ষোভের ভিতরে যা কিছু ঘটছে সেগুলো বোঝার ontological সমস্যাও সেখানে বিদ্যমান। এটা কি দুর্নীতিবাজ শহুরে জনপ্রশাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম মাত্র? এটা স্বৈরাচারী ইসলামী শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম? এটা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত স্থান বেসরকারীকরণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম? প্রশ্নের দরজা উন্মুক্ত এবং কিভাবে এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়া হবে তার চরিত্রের উপরই নির্ভর করছে চলমান রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ফলাফল।
২০১১ সালে যখন ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে প্রতিনাদ-বিক্ষোভ সূচনা হলো তখন অনেকে জোর দিয়ে বলেছেন একে বিশ্বব্যাপী আন্দোলনের দৃষ্টান্ত হিসাবে গণ্য করা উচিত নয়। তারা বরং যুক্তি পাড়লেন, প্রতিটি বিক্ষোভ একটি সুনির্দিষ্ট অবস্থার পরিপেক্ষিতে গড়ে ওঠা প্রতিক্রিয়া মাত্র। অন্যান্য দেশে গড়ে ওঠা ‘অকুপাই’ আন্দোলনের মত মিশরে প্রতিবাদকারীরা চেয়েছে ‘স্বাধীনতা’ এবং ‘গণতন্ত্র’। এমনকি মুসলিম দেশগুলোর মধ্যেও আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য বিদ্যমানঃ মিশরের আরব বসন্ত ছিল একটি দুর্নীতিগ্রস্ত স্বৈরাচারী পাশ্চাত্যমুখী শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ; ২০০৯ সালে শুরু হওয়া ইরানের সবুজ বিপ্লব ছিল স্বৈরাচারী ইসলামবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। যারা বর্তমান অবস্থা স্থিতাবস্থা জিইয়ে রাখতে চায় তারা বিক্ষোভগুলোর উপর এমন বিশেষত্ব আরোপ করেনঃ যেন এসব বিক্ষোভ সাজানো বিশ্বের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে কোন হুমকি নয়, কেবলমাত্র ভিন্ন ভিন্ন স্থানীয় সমস্যার সারি।
গ্লোবাল পুঁজিবাদ একটি জটিল প্রক্রিয়া যা বিভিন্ন উপায়ে বিভিন্ন দেশকে প্রভাবিত করে। বিভিন্নমুখী হলেও যা জাগরিত প্রতিবাদগুলোকে একসূত্রে বেঁধে রেখেছে তা হল এই জাগরণ পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের বিভিন্ন চেহারার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ। আজকের বিশ্ব পুঁজিবাদের সাধারণ প্রবণতা হল বাজার ব্যবস্থার আরও সম্প্রসারণ, জনগনের জন্য উন্মুক্ত স্থানগুলোকে বন্ধ করে দেয়া, সরকারী সেবা হ্রাস (স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি), এবং ক্রমবর্ধমান একনায়কতন্ত্রী রাজনৈতিক ক্ষমতা। এই প্রেক্ষাপটে গ্রীসের জনগন প্রতিবাদ করছে আন্তর্জাতিক আর্থিক মূলধন এবং নিজেদের দুর্নীতিগ্রস্ত ও অদক্ষ রাষ্ট্র চরিত্রের বিপক্ষে যা তাদের মৌলিক সামাজিক সেবা প্রদানের ক্রমে ক্রমে অক্ষম হয়ে পড়ছে। সেই একই প্রেক্ষাপটে তুরস্কের জনগন প্রতিবাদ করছে জনগনের জন্য উন্মুক্ত স্থান বাণিজ্যিকীকরণের ও ধর্মীয় একনায়কত্বের বিরুদ্ধে; মিশরের জনগন প্রতিবাদ করছে পাশ্চাত্য ক্ষমতা দ্বারা সমর্থিত সরকারের বিরুদ্ধে; ইরানের জনগন দুর্নীতিপরায়নতা ও ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে। এইসকল বিক্ষোভকে কোনো একটি একক-সমস্যার টোপে আটকানো যাবে না। এসবের পিছনে অন্তত দুটি বিষয়ের সুনির্দিষ্ট সমন্বয় রয়েছেঃ একটি হল অর্থনৈতিক (দুর্নীতি থেকে অদক্ষতা ও পুঁজিবাদ), আর অন্যটি হল রাজনৈতিক-মতাদর্শগত (গণতন্ত্রের দাবী থেকে প্রচলিত বহুদলীয় গণতন্ত্র উৎখাতের দাবী)। এই একই কথা খাটে অকু্যপাই আন্দোলনের বেলায়। ভুরি ভুরি বিবিধ (প্রায়ই বিভ্রান্ত) বিবৃতির পিছনে আন্দোলনের দুটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলঃ প্রথমত, শুধুমাত্র কোনো বিশেষ স্থানীয় দুর্নীতি নয়, একটি ব্যবস্থা হিসাবে পুঁজিবাদের উপর অতৃপ্ত; দ্বিতীয়ত এমন একটি সচেতনতা যে, সংস্থাগত প্রতিনিধিত্বশীল বহুদলীয় গণতন্ত্র পুঁজিবাদের অপরিমিতির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য যথেষ্ঠ রকম নয়; অর্থাৎ গণতন্ত্রকে এজন্য নতুন করে আবিষ্কার করতে হবে।
বিক্ষোভের অন্তর্নিহিত কারণ বিশ্ব পুঁজিবাদ বলে তার একমাত্র সমাধান পুঁজিবাদের সরাসরি উৎখাত নয়। তাই বলে আবার বিরাজমান ভিন্ন ভিন্ন সমস্যাগুলোকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা এবং কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তনের আশায় অপেক্ষা করার মত প্রায়োগিক বা সহজসিদ্ধ বিকল্প পথ-যাত্রাও টেকসই নয়। তাহলে আমরা এই সত্য উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হব যে, বিশ্ব পুঁজিবাদ আসলে সঙ্গতিহীনঃ কৃষকের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক সহযোগিতা আর মুক্তবাজার হাতে হাত রেখেই চলে, গনতন্ত্রের প্রচার কার্য সৌদী আরবকে সমর্থনের সাথে হাতে হাত রেখে পরিচালিত হয়। এই অসঙ্গতি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের জন্য একটি উন্মুক্ত স্থান খুলে দেয়ঃ যখনই বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থা তার নিজের নীতিই লঙ্ঘন করতে বাধ্য হয় তখনই তার সেই নীতি মেনে চলার জন্য বাধ্য করার সূযোগ তৈরী হয়। কৌশলগতভাবে নির্দিষ্ট মুহূর্তে মুহুর্তে সঙ্গতি স্থাপনের দাবী – যে সঙ্গতি ঐ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার ক্ষমতা রাখে না – পুরা ব্যবস্থার উপরই চাপ সৃষ্টি করে। সে রাজনীতিই শৈল্পিক যে রাজনীতি এমন নির্দিষ্ট দাবী উত্থাপন করতে পারে যা একদিকে পুরাপুরি বাস্তববাদী কিন্তু যা আধিপত্যবাদী মতাদর্শের কেন্দ্রে আঘাত করতে পারে এবং বেশী করে আমুল পরিবর্তনের তাগাদা দেয়। এমন দাবী বিশ্বাসযোগ্য এবং ন্যায়সঙ্গত হলেও অর্জনের বিচারে প্রকৃতপক্ষে অসম্ভব। প্রেসিডেন্ট ওবামার সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা সে-রকমই একটি উদাহরন, সেজন্যই এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া এত তীব্র।
কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু হয় একটি কাঙ্খিত ধারনা থেকে, কিন্তু সময়ে সময়ে সেই ধারনা ব্যাপক পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মধ্য অতিক্রম করে যা শুধু কৌশলগত নয়, প্রয়োজন হয় সে ধারণাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করারও, সে ধারণা আন্দোলনের প্রক্রিয়ার অংশও বটে; ফলে সেই আন্দোলন অতি মাত্রায় নির্ধারিত মনে হয়। (মার্কস তাঁর ‘রাজনৈতিক অর্থনীতির সমালোচনা প্রসঙ্গে’ এর ভূমিকায় লিখেছিলেন যে, মানবজাতি শুধু সেইসব করণীয়ের মুখোমুখী হয় যেগুলোর সমাধান সে করতে পারে। যদি কথাটাকে ঘুরিয়ে বলি যে, এক সূত্রে মানবজাতি কেবল সেইসব করণীয়ের মুখোমুখী হয় যেগুলোর সমাধান সে করতে পারে না, ফলে এমন প্রক্রিয়ার উত্থান ঘটায় যা সম্পর্কে আগে থেকে অনুমান করা যায় না এবং যার মধ্য দিয়ে করণীয় আসলে পুনঃনির্ধারিত হয়।) ধরুন, আইনের শাসনের ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য কোনো আইনী বিধি পরিনর্তনের দাবী নিয়ে শুরু হওয়া আন্দোলন বিক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। জনগন যখন ঐ আন্দোলনে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ে তখন তারা উপলব্ধি করতে পারে যে, যদি ঐ দাবীর প্রাথমিক অর্জন নিশ্চিত করতে হয় তাহলে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য আরও অনেক কিছু করার প্রয়োজন। সমস্যা হলো, কি সেই ‘আরও অনেক কিছু’ তা সংজ্ঞায়িত করা। উদারবাদী-বাস্তববাদীদের মত হলো, সমস্যার সমাধান সম্ভব এক এক করেঃ ‘রোয়ান্ডায় মানুষ মারা যাচ্ছে, তাই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম এখন স্থগিত রাখুন, আসুন মানুষ নিধন বন্ধ করি আগে’; অথবা ‘পুঁজিবাদের সাজানো ঘর ধ্বসে পড়ার জন্য অপেক্ষা নয়, আসুন এখানে-সেখানে দারিদ্র্য্য ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি’। ‘ইশ্বরের মৃত্যুর পর’ (২০০৭) নামক এক গ্রন্থে জন কাপুতো এমনতর যুক্তিই পেড়েছেনঃ
“আমি পুরাপুরি খুশী হবো যদি আমেরিকার অতিবাম রাজনীতিবিদরা বর্তমান ব্যবস্থার মধ্যে এমন সংস্কার করতে পারেন যা নিশ্চিত করবে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা, আই.আর.এস এর ট্যাক্স কোড পরিবর্তনের মাধ্যমে কার্যকর করবে সম্পদের আরো সুষম পুনর্বন্টন, সীমাবদ্ধ করবে নির্বাচনী প্রচারণার অর্থায়ন, নিশ্চিত করবে সকল নাগরিকের ভোটাধিকার, অভিবাসী শ্রমিকদের সাথে মানবিকভাবে আচরণ, এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাকে সংযুক্ত করতে পারে এমন একটি বহুপাক্ষিক বৈদেশিক নীতি, ইত্যাদি ইত্যাদি; মানে হলো দরকারী ও সুদূরপ্রসারী সংস্কারের মাধ্যমে পুঁজিবাদকে হস্তক্ষেপ করা ……. যদি এইসব কিছু নিশ্চিত করার পর বাইদু এবং জিজেক অভিযোগ করেন যে, কোনো দৈত্য পুঁজিবাদকে এখনও তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে, তাহলে আমি ঐ দৈত্যকে অভিনন্দন জানাতে আগ্রহী হব”।
কাপুতোর উপসংহার এখানে সমস্যা নয়ঃ আমরা যদি পুঁজিবাদের মধ্যে থেকে এসবই আর্জন করতে পারতাম, তাহলে ঐ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় থেকে যাই না কেন? সমস্যা হলো তার পূর্ব-অনুমান নিয়ে, যার মানে হলো আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদের বর্তমান কাঠামোয় এই সবই অর্জন সম্ভব। কিন্তু কাপুতো পুঁজিবাদের যে সকল অসন্তোষজনক ব্যর্থতার কথা বলেছেন সেগুলো শুধুমাত্র ঘটনাচক্রে না-ঘটে যদি একান্তভাবে পুঁজিবাদের কাঠামোগত ব্যাপার-স্যাপার হয়? কাপুতোর স্বপ্ন যদি কোনো রোগের লক্ষণ না-হয়ে সার্বজনীন পুঁজিবাদের এমন স্বপ্ন হয়ে থাকে যা সঙ্কটময় কোনো এক মুহূর্তে ‘অবদমিত সত্য’ হয়ে আত্মপ্রকাশ করে?
আজকের বিক্ষোভ আর বিদ্রোহ যুগপতভাবে বিভিন্ন দাবীর সাথে একত্রিত হয়ে বিরাজ করছে, এবং সেটাই এর শক্তির কারণঃ তারা সংগ্রাম করছে স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে (‘স্বাভাবিক’, সংসদীয়) গনতন্ত্রের জন্য, ব্যবসা ও রাজনীতিতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে (শিল্প-কারখানার মাদ্যমে পরিবেআহ দূষণ), নয়া-উদারনৈতিকতার বিপরীতে কল্যানমুখী রাষ্ট্রের জন্য, এমন একটি নতুন গনতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য যা প্রথাগত বহুদলীয় আচার ব্যবস্থাকে অতিক্রম করে যাবে। বিক্ষোভকারীরা আসলে বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে চায় এবং পুঁজিবাদের বাইরে একটি সমাজ ব্যবস্থার ধারণা বাঁচিয়ে রাখতে চায়। এখানে দুইটি ফাঁদ এড়িয়ে যেতে হবেঃ শুধু মিথ্যা কট্টরপন্থা (উদার সংসদীয় পুঁজিবাদ রদ করার আবশ্যিকতা, আর বাকী সনই গৌন) নয়, মিথ্যা ক্রমবাদ ও (‘আমাদের এখনই সামরিক একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধ এবং মৌলিক গনতন্ত্রের জন্য লড়াই কেআ উচিত’)। এখানে মাও সেতুং এর প্রাথমিক ও দ্বিতীয় বিরোধবাদের পার্থক্যের কথা স্মরণ করা যেতে পারে: যা-কিছু আসলে শেষমেশ গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে এবং যা-কিছু এখন প্রভাববিস্তারী সেই পার্থক্য। কখনও কখনও এমন এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় যখন প্রথম বিরুদ্ধবাদের উপর আস্থার মানে হলো সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ আঘাত হানার সূযোগ ব্যবহার করতে না পারা।
অতিমাত্রায় নির্ধারিত হওয়ার যে জটিলতা তাকে নিয়ে যে রাজনীতি একমাত্র সেই রাজনীতিই কৌশলগত হওয়ার দাবী রাখে। যখন আমরা কোনো নির্দিষ্ট সংগ্রামে যোগদান করি তখন মূল যে প্রশ্নের মুখোমুখী আমরা হই তা হলঃ এই সংগ্রামে আমাদের অংশগ্রহন করা বা না-করা কিভাবে অন্যান্য সংগ্রামের উপর প্রভাব ফেলবে? সাধারণ সূত্র হল – যখন কোনো নিপীড়নকারী আধা-গনতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সূত্রপাত হয়, যেমন ২০১১ সালে হয়েছিল মধ্যপ্রাচ্যে, গনতন্ত্রের পক্ষে, দুর্নীতির বিপক্ষে শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত বিরাট এক জনগোষ্ঠী সম্পৃক্ত করা সহজ। কিন্তু শীঘ্রই আমরা কঠিন সিদ্ধন্তের মুখোমুখী হই। বিদ্রোহ যখন প্রাথমিক লক্ষ্য অর্জনে সমর্থ হয় তখন আমরা উপলব্দি করি যে, যে সব বিষয় নিয়ে আমরা অস্বস্তি বোধ করি (স্বাধীনতা বা মুক্তির অভাব, আমাদের সীমাবদ্ধতা, দুর্নীতি, ভবিষ্যত) সেগুলো নতুন এক আবরণে আবির্ভূত হয়, ফলে আমরা এমন আমরা এমন সিদ্ধান্তে আসতে বাধ্য হই যেনবা আমাদের অভীষ্ট লক্ষে্য কোথাও ভুল কিছু বিদ্যমান ছিল। এর মানে এমনও হতে পারে যে, গনতন্ত্র যেন নিজেই অ-মুক্তির কোনো বিশেষ রূপ, অথবা শুধুমাত্র রাজনৈতিক গনতন্ত্র নয় – তার চেয়েও বেশী কিছু দাবী করা দরকার ছিল – প্রয়োজন ছিল সামাজিক ও অর্থনৈতিক গনতন্ত্রেরও। সংক্ষেপে বলা যায়ঃ যা আমরা প্রথমেই নীতির (গনতান্ত্রিক মুক্তি) সম্পূর্ন ব্যর্থতা হিসাবে গন্য করি সে ব্যর্থতা আসলে ঐ নীতির স্বভাবের মধ্যেই নিহিত। যে নীতির জন্য সংগ্রাম করছি সে নীতির স্বভাবের মধ্যে যে ব্যর্থতা বিরাজমান – এই উপলব্ধিই আমাদের রাজনৈতিক শিক্ষার জন্য এক বিরাট অর্জন।
এই বৈপ্লবিক সিদ্ধন্তে যেন আমরা না পৌঁছাতে পারি তার জন্য বিরাজমান মতাদর্শনের প্রতিনিধিত্বকারীরা সর্বতোভাবে নিজেদের যত কৌশল আছে তা ব্যবহার করতে উদ্ধত হয়। তারা বলে, গনতান্ত্রিক মুক্তি দায়িত্ববোধের জন্ম দেয়, এই মুক্তি অর্জনে জন্য আমাদের মূল্য দিতে হয়, গনতন্ত্রের কাছে খুব দ্রুত খুব বেশী আশা করা বালখিল্যতা। তারা বলে, পুঁজিবাদীরা যেমন বিনিয়োগ করে তেমনি আমাদেরও একটি মুক্ত সমাজে নিজেদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে জীবনের জন্য বিনিয়োগে নজর দেয়া উচিতঃ যদি আমরা প্রয়োজনীয় ত্যাগ স্বীকারে ব্যর্থ হই, সংক্ষিপ্ত পথে দ্রুত লক্ষ্যে পৌঁছাতে চাই তাহলে নিজেদেরই নিজে তার জন্য দায়ী করা ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না। রাজনৈতিক অর্থে আরও সরাসরি বলতে গেলে বলতে হয়, জনপ্রিয় বিদ্রোহ বা বিক্ষোভগুলোকে একপ্রকার গ্রহনযোগ্য সংসদীয় পুঁজিবাদী ব্যবস্থার আন্দোলনে পর্যবসিত করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি বরাবর শাক দিয়ে মাছ ঢাকার কৌশল ব্যবহার করেছে, যেমন তারা করেছে দক্ষিন আফ্রিকায় বর্ণবাদী সংঘাতৃ পর, ফিলিপাইনে করেছে মার্কোসের পতনের পর, ইন্দোনেশিয়ায় সুহার্তের পতনের পর। সত্যিকার রাজনীতির শুরু এখানেইঃ বিক্ষোভ বিদ্রোহের পরিনতিতে পরিবর্তনের যে প্রথম অর্জন তাকে কি করে আরও গতিশীল করা যায়, ‘একনায়কত্বের’ ফাঁদে না-পড়ে কি করে আন্দোলনকে পরবর্তী স্তরে উত্তরণ করা যায়, কিভাবে রবার্ট মুগাবে না হয়ে নেলসন ম্যান্ডেলাও অতিক্রম করা – এইসব প্রশ্ন অতি জরুরী।
কি হতে পারে এত সব কথার সুনির্দিষ্ট বাস্তব উদাহরণ? তাহলে আসুন, গ্রীস এবং তুরস্ক – এই দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে তুলনা করি। প্রথম দেখায় মনে হয়, এই দুইটি বুঝি পরষ্পর থেকে একেবারেই ভিন্নঃ গ্রীস কৃচ্ছ্বসাধনের বিধ্বংসী রাজনীতির ফাঁদে আটকে আছে, আর তুরস্ক দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে সম্বৃদ্ধির দিকে – হয়ে উঠছে নতুন এক আঞ্চলিক মহাশক্তি। কিন্তু ব্যাপারটি যদি এমন হয়, তুরস্ক আসলে তলে তলে গ্রীসের অভিজ্ঞতাই রচনা করে যাচ্ছে, অন্তরে ধারণ করে আছে গ্রীস-ই, নিজেই রচনা করছে তার দুর্গতির আখ্যান? ব্রেখ্ট তাঁর ‘হলিউড এলিজিগুলো’তে যেমন বলেছেনঃ
বেহেশত নিয়ে এখানে যে ধারণা মানুষের সে ধারণায় তারা
গড়ে তুলতে চেয়েছিল হলিউড গ্রাম। জানত
তারা আল্লাহ’র চাই বেহেশত, দোজখ দু-ই, তবু তারা
ভাবেনি দুই-ই নিয়ে, ভেবেছে শুধু একটি নিয়েঃ বেহেশত। পায়নি
সম্বৃদ্ধি বা সফলতা, এখন
সে-এক নরক।
আমাদের আজকের ‘বিশ্বপল্লী’ অনেকটা এমনইঃ ভাবুন কাতার আর দুবাইয়ের কথা যেখানে অভিবাসী শ্রমিকদের দাসত্বের বিনিময়ে ধনিক শ্রেনীর জৈলুস। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে গ্রীস আর তুরস্কের বিরাজমান মিলগুলো উপলব্ধি করা সম্ভবঃ বেসরকারীকরণ, জনগনের জন্য উন্মুক্ত স্থান অধিগ্রহন, সেবামূলক ব্যবস্থার ধ্বংস এবং একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থার উদ্ভব। গ্রীস আর তুরস্কের বিক্ষোভকারীরা প্রাথমিকভাবে আসলে একই সংগ্রামের অংশীদার। লক্ষ্য অর্জনে সত্যিকার উপায় হল এই দুই সংগ্রামের মধ্যে পারষ্পরিক সহযোগীতার সম্পর্ক তৈরী করা, আর ‘দেশপ্রেমে’ প্রলুব্ধ হওয়ার অবস্থা প্রত্যাখ্যান করা, দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান ঐতিহাসিক শত্রুতা পিছনে ফেলে সহযোগিতার ক্ষেত্র খুঁজে বের করা। এই সংগ্রামের ভবিষ্যত হয়ত এরই উপর নির্ভর করছে।