প্রযুক্তিগত পুনরুৎপাদনযোগ্যতার যুগে শিল্পকলার ভূমিকা (পর্ব ১) / ওয়াল্টার বেনিয়ামিন

(মার্চ বা এপ্রিল ১৯৩৯ সালে রচিত; বেনিয়ামিনের জীবদ্দশায় অপ্রকাশিত। ইংরাজি অনুবাদঃ হ্যারি জোহান এবং এডমন্ড জেফকোট। এটি তৃতীয় সংস্করণ থেকে বাংলায় অনুদিত। বেনিয়ামিন ১৯৩৬ সালের প্রথম দিকে ফরাসী ভাষায় অনুবাদসহ একটি জার্মান সাময়িকীতে প্রকাশের ইচ্ছায় প্রবন্ধটি ফ্রান্সে বসে শেষ করেছিলেন। গ্রেটেল অ্যাডর্নোকে অনুলিপি করার অনুমতি দেওয়ার আগে তিনি দুই বছরে অসংখ্য পরিবর্তন পরিবর্ধন করেছিলেন। ১৯৩৯ সালের শেষের দিকে এসেও বেনিয়ামিন এই উল্লেখযোগ্যভাবে সংশোধিত সংস্করণটিকে একটি সম্পন্ন কাজ হিসাবে বিবেচনা না-করে চলমান কাজ হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন।)

আমাদের চারুকলা তার নমুনা ও ব্যবহারের ধরন নিয়ে বিকশিত হয়েছে, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাদের দ্বারা সমসাময়িকতার উপর যাঁদের কর্মশক্তি আমাদের তুলনায় তুচ্ছ ছিল এবং তা হয়েছে এমন এক সময়ে যা আমাদের কালের চেয়ে অনেক ভিন্ন। তবে প্রযুক্তির আশ্চর্যজনক বিকাশ, তার খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষমতা এবং নির্ভুলতা, যে ধারণা এবং অভ্যাসের জন্ম দিয়েছে তা সুন্দরের প্রাচীন নৈপুণ্যে গভীর পরিবর্তন আসন্ন করে তুলেছে। সমস্ত শিল্পকর্মে এমন শারীরিক উপাদান এসেছে যাকে আর আগের মতো করে বিবেচনা করা যায় না, যা আমাদের আধুনিক জ্ঞান এবং ক্ষমতা দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে থাকার কোন উপায় নাই। প্রাচীন কাল থেকে বস্তু, স্থান বা সময় সম্পর্কে যে ধারণা প্রচলিত ছিল গত বিশ বছর ধরে তা আর বিদ্যমান নাই। শিল্পকর্মের পুরো কলা-কৌশল রূপান্তর করতে আমাদের এখন অবশ্যই দুর্দান্ত উদ্ভাবনীর প্রত্যাশা করতে হবে, যার ফলে শৈল্পিক আবিষ্কার নিজেই নিজেকে প্রভাবিত করবে এবং যা এমনকি শিল্পকর্ম সম্পর্কে প্রচলিত ধারণায় আশ্চর্যজনক পরিবর্তন আনতে পারে।পল ভ্যালেরি, Pieces sur l’art (” La Conquete de l’ubiquite”)

ভূমিকা
মার্কস যখন তার পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতির বিশ্লেষণ করেছিলেন তখন এই পদ্ধতি তার শৈশবে ছিল১। মার্কস এমন একটি পন্থা অবলম্বন করেছিলেন যা তাঁর অনুসন্ধানকে পূর্বাভাসমূলক মান দিয়েছে। পুঁজিবাদী উৎপাদনের মৌলিক শর্তের দিকে ফিরে তিনি সেগুলি এমনভাবে উপস্থাপন করেছিলেন যা দেখিয়েছে পুঁজিবাদ থেকে ভবিষ্যতে আমরা কি আশা করতে পারি। সেই আশা পরিপূর্ণতা পেয়েছে এই সত্যে যে, পুঁজিবাদ শুধু সর্বহারা শ্রেণীর ক্রমবর্ধমানভাবে কঠোর শোষণই করে না, শেষ পর্যন্ত পুঁজিবাদ নিজেকেই নিজে বিলুপ্ত করার শর্ত তৈরি করে।

যেহেতু উপরিকাঠামোর রূপান্তর অবকাঠামোর তুলনায় অনেক ধীরে ধীরে সম্পন্ন হয়, উৎপাদনের শর্তগুলি পরিবর্তনের মাধ্যমে সংস্কৃতির সকল ক্ষেত্রে তার প্রভাব বিকাশে অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় লেগে গিয়েছিল। এই প্রক্রিয়াটি কিভাবে সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছে কেবলমাত্র এখনই তা মূল্যায়ন করা যেতে পারে এবং এই মূল্যায়নগুলি অবশ্যই কিছু পূর্বাভাসমূলক শর্ত পূরণ করতে বাধ্য। এই মূল্যায়নগুলি অবশ্য ক্ষমতা দখলের পরে সর্বহারা শ্রেণীর শিল্পকলার পক্ষের কোনো যুক্তি দাবী করে না এবং শ্রেণিহীন সমাজের শিল্পকলার পক্ষে সে যুক্তির দাবী আরও অগুরুত্বপূর্ণ। বরং তারা বর্তমান উৎপাদনের ব্যবস্থার অধীনে শিল্পকলা বিকাশের প্রবণতাগুলি সংজ্ঞায়িত করার যৌক্তিকতা আহ্বান করে। উৎপাদন ব্যবস্থার এই শর্তগুলির দ্বান্দ্বিকতা অর্থনীতিতে যতখানি উপরিকাঠামোতে তার চেয়ে কম সুস্পষ্ট নয়। শিল্পকলা বিকাশের প্রবণতাগুলি সংজ্ঞায়িত করার যৌক্তিক ব্যাখ্যা তাই রাজনৈতিক লড়াইয়ে এমন অবদান রাখতে পারে যা খাটো করে দেখা ভুল। তারা সৃজনশীলতা এবং প্রতিভা, চিরন্তন মূল্য এবং রহস্য – এই সকল চিরাচরিত ধারণাগুলিকে নিরপেক্ষতা প্রদান করে, এই ধারণাগুলির প্রকৃত উপাদান এবং অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার (এবং তাদের নিয়ন্ত্রণ করা আজ কঠিন) ফ্যাসিবাদের স্বার্থে অপব্যবহারের সুযোগ করে দেয়। সেই অনুসারে শিল্পকলার তত্ত্বের মধ্যে যে ধারণাগুলি প্রবর্তিত হয় তা বর্তমানে বিদ্যমান ধারণাগুলি থেকে ভিন্ন এবং তারা বিরোধের উদ্দেশ্য হিসাবে সম্পূর্ণ অকার্যকর। অন্যদিকে তারা শিল্পকলার [Kunstpolitik] রাজনীতিতে বিপ্লবী দাবী গঠনের জন্য কার্যকর। (চলবে… )

টীকাঃ
১. জার্মান রাজনৈতিক দার্শনিক কার্ল মার্কস (১৮১৮ -১৮৮৮)। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত এবং প্রভাবশালী রচনা ‘দাস ক্যাপিটাল’ (৩ খণ্ড, ১৮৬৭, ১৮৮৫, ১৮৯৫) -এ পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার বিশ্লেষণ করেছিলেন, যা তাঁর সহযোগী ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের (১৮২০ – ১৮৯৫) হাতে পরিপূর্ণতা পায়। বেনিয়ামিনের এপিগ্রাফের অনুবাদ পল ভ্যালেরির Aesthetics বইয়ের “The Conquest of Ubiquity” প্রবন্ধ থেকে – অনুবাদকঃ রাল্ফ ম্যানহিম (নিউ ইয়র্ক: প্যানথিয়ন, ১৯৬৪), পাতা ২২৫। পল ভ্যালেরি (১৮৭১ – ১৯৪৫) একজন ফরাসী বিদ্বান যিনি লিখেছেন Charmes (১৯২২), প্রবন্ধ গ্রন্থ, যেমন Soiree avec M. Teste (১৮৯৫) and Analecta (১৯২৭)।

(পর্ব ২)

Leave a Reply

আপনি এখান থেকে কপি করতে পারবেন না!