নিজেদের সামাজিক অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে লেখকরা পিছিয়ে পড়া জনসংখ্যার মধ্যে সবচেয়ে পিছনে। তারা কেবল একে অপরকে সহকর্মী হিসাবে বিবেচনা করে; নিজেদের সিদ্ধান্ত গঠন এবং স্বার্থ রক্ষার জন্য তাদের প্রস্তুতি পদমর্যাদায় উপরে যারা তাদের প্রতি যেমন তার চেয়ে বেশী পদমর্যাদায় যারা নীচে যারা তাদের দিকেই তৎপর। তারা কখনও কখনও প্রকাশকের কাছ থেকে ভাল চুক্তি আদায় করে নেয়। তবে বেশিরভাগই তাদের লেখার সামাজিক ভূমিকার বিবরণ দিতে অক্ষম, এবং সেই অনুসারে প্রকাশকদের সাথে লেনদেনে তারা তাদের এই ভূমিকার কার্যকারিতা প্রতিফলনে ব্যর্থ। নিঃসন্দেহে এমন প্রকাশক রয়েছে যারা তাদের নিজস্ব ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে একটি নিখুঁত দৃষ্টিভঙ্গি রাখে এবং যারা সত্যই বিশ্বাস করে যে তাদের একমাত্র নৈতিক কাজ হলো ভাল বই এবং মন্দ বইয়ের মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণ করা, এবং তাদের একমাত্র বাণিজ্যিক লক্ষ্য হল কোন বই বাজার পাবে আর কোনটি পাবে না তা ঠিক করা। তবে সাধারণভাবে, কোন পাঠকের কাছে কোন ধরণের বই বিক্রয় করতে হবে সে সম্পর্কে একজন প্রকাশকের যে পরিষ্কার ধারণা রয়েছে তা লেখক ঠিক কোন পাঠকদের জন্য লিখছেন সে ব্যাপারে তার যে ধারণা তার সাথে তুলনীয় নয়। এ কারণেই লেখককে প্রকাশকের সাথে এক করে দেখার কোনো সুযোগ নাই, এবং লেখককের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রকাশকের অবস্থানও শক্ত নয়। তাহলে আর কেই বা তা করতে পারে? অবশ্যই পড়ুয়া জনমানুষ নয়; প্রকাশকদের কর্মকান্ড তাদের কল্পনাশক্তির সীমানার বাইরে। তাহলে বিচারের আদালত বাকি থাকে একমাত্র খুচরা বিক্রেতা। খুচরা বিক্রেতাদের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ কতটা সমস্যাযুক্ত তা বলার অপেক্ষা রাখে না, যদি তার কারণ কেবলমাত্র দায়িত্বজ্ঞানহীনতা এবং গোপনীয়তা।
তাহলে ব্যাপারটি সুস্পষ্ট। এর থেকে উত্তরণ রাতারাতি সম্ভব নয় এবং পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এটি কখনই পুরোপুরি অর্জন করা যাবে না, তাই বলে বিষয়টি উত্থাপনে আমাদের বাঁধা থাকা উচিত নয়। অনিবার্যভাবে পূর্বশর্ত হিসাবে যা আমাদের করতে হবে তা হলো প্রকাশনা জগতে নিয়োজত মূলধনের একটি পরিসংখ্যানগত জরিপ। এই অবস্থান থেকে আমাদের অনুসন্ধান দুটি দিকে এগিয়ে যাওয়া উচিত। একদিকে, জানতে হবে এই প্রশ্নের উত্তরঃ এই পুঁজির উৎস কি? অন্যভাবে বললে, ব্যাংকিং, টেক্সটাইল, কয়লা, ইস্পাত এবং মুদ্রণ শিল্প থেকে প্রকাশনা খাতে কি পরিমাণ পুঁজি স্থানান্তরিত হয়েছে? অন্যদিকে, বইয়ের বাজারে প্রকাশনা পুঁজি আসলে কি ভূমিকা রাখছে? এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রশ্নগুলিকে একত্রিত করার একটি ছোট পদক্ষেপ নিতে হবে, এবং অনুসন্ধান করতে হবে যে, প্রকাশনাখাতে পুঁজির বিকাশ কি কোনো নির্দিষ্ট ক্রেতাগোষ্ঠীকে এবং প্রবণতাকে লক্ষ্য করে হয়েছে, যেমন ধরুন, পুঁজি টেক্সটাইল খাতে না গিয়ে কয়লা এবং ইস্পাত খাতে স্থানান্তরিত হয়েছে। তবে খুব শীঘ্রই এই তৃতীয় ধাপের পরিসংখ্যানগত ভিত্তি অর্জনের প্রচেষ্টায় কোনো প্রকল্প গ্রহণের সম্ভাবনা কঠিন। বিপরীতে, স্বয়ং প্রকাশকদের কাছ থেকে নিয়মিত বিরতিতে বিভিন্ন বাজারে বই বিক্রীর পরিসংখ্যানগত তথ্যের সহজ পরিপূরক হিসাবে কাজ করতে পারে জনসাধারণ এবং বই বিক্রেতাদের মতামত জরিপ যদিও তা আরও অনির্ভরযোগ্য। যেহেতু প্রকাশকরা যথারীতি বিভিন্ন সংস্করণের আকার আমাদের অবহিত করে, ফলে এটি কোনো বিপদজনক পদক্ষেপ হিসাবে বিবেচিত হওয়া উচিত নয়, যদি কেউ সেভাবে ভেবেও থাকে। সবচেয়ে আগ্রহের বিষয় হলো, একটি সংস্করণের আকার এবং বিজ্ঞাপন ব্যয়ের আকারের মধ্যে যে সম্পর্ক তার পরিসংখ্যানগত তথ্য; একইভাবে, বাণিজ্যিক সাফল্যের (বিক্রয়ের পরিমাণ) এবং সাহিত্যিক সাফল্যের (সংবাদমাধ্যমে সমালোচিত গ্রহণযোগ্যতা) মধ্যে সম্পর্কের একটি পরিসংখ্যানমূলক চিত্র। সবশেষ এবং সবচেয়ে কঠিন বিষয় হলোঃ প্রত্যেক প্রকাশক এবং সামগ্রিকভাবে জার্মান বইয়ের বাজার বাণিজ্যিকভাবে সফল এবং অসফল বইয়ের একটি শতাংশিক হিসাব প্রতি বছর প্রকাশ করতে পারে।
এই পদ্ধতি অনুযায়ী বইয়ের প্রাসঙ্গিকতার বিচারে বাণিজ্যিক সাফল্য একমাত্র মানদন্ড বলে বিবেচিত হতে পারে এমন আপত্তি যেমন মিথ্যা তেমনি সুস্পষ্ট। অবশ্যই এমন মূল্যবান বই রয়েছে যা বাজারে ব্যর্থ, এবং একজন ভাল প্রকাশক তবুও কেবল সম্মানের খাতিরে নয়, প্রকাশণার নীতিমালার ভিত্তিতেও বিক্রি করতে চান। (একইভাবে, কনফেকশনারীর মালিকরা তাদের দোকানের উইন্ডোগুলিতে চিনির আইসিং করা দুর্গ এবং চকলেট-ক্যান্ডির টাওয়ারগুলি সাজিয়ে রাখেন, বিক্রীর উদ্দেশ্যে নয়।) প্রকাশনা নিয়ে বর্তমানে প্রচলিত সবচেয়ে সাধারণ – সবচেয়ে ভ্রান্ত – দৃষ্টিভঙ্গি দূর করতে আমরা বিশ্লেষণের এই দাবী জাতির আত্মিক প্রবাহ অনুসন্ধানে বইয়ের ভূমিকা নিয়ে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। এই মতামত অনুসারে, প্রকাশনা সংস্থা একটি সম্মিলিত উদ্যোগ, যেখানে একদিকে সংগঠিত পৃষ্ঠপোষকতা এবং অন্যদিকে এক লটারি খেলার সমন্বয় আমরা দেখি, যেখানে প্রতিটি নতুন বই একটি সংখ্যা এবং পাঠক যেন এক একজন ব্যাংকার। খেলোয়াড়দের (অন্য কথায়, প্রকাশকদের) জয়ের দিক থেকে সংখ্যার উপর বাজি ধরা দুর্দান্ত এবং তাৎপর্যপূর্ণ, তবে পাঠকদের রুলেটে সেই সংখ্যার খোঁজ দুষ্প্রাপ্য। সংক্ষেপে, এটি প্রকাশনার বিমূর্ত দৃষ্টিভঙ্গিঃ একদিকে, প্রকাশক প্রতিটি পাণ্ডূলিপির, অন্যদিকে, ‘নির্দিষ্ট’ পাঠকের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী। কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গি পুরাপুরি ভুল, কারণ প্রকাশক শূন্যে বসে কোনো বইয়ের আদর্শ মূল্য বা বাণিজ্যিক মূল্য সম্পর্কে নিজস্ব মতামত গঠনের অবস্থানে থাকে না। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে, প্রকাশককে সাহিত্যের নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতে হয় – সেই নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট পথ অনুসরণ করার প্রয়োজন হয় না – কারণ পাঠকদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য এটিই তার একমাত্র উপায় যা ছাড়া ব্যবসা ব্যর্থ হতে বাধ্য। স্পষ্ট মনে হলেও এটা কম আশ্চর্যজনক নয় যে, জার্মানিতে যেখানে রয়েছে চোখে পড়ার মত বেশিরভাগ প্রকাশনা সংস্থা – ইনসেল, রেকলাম, এস. ফিশার, বেক এবং রাওহল্ট – যেগুলির উপর পর্যালোচনা দুরে থাক, কোন সমাজতাত্ত্বিক অধ্যয়নের চেষ্টা আজও হয়নি। তবুও এটাই হলো এইসব বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থাগুলি থেকে গঁজিয়ে ওঠা বেসরকারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিদ্যমান পার্থক্যের পরিমাপক, যে প্রতিষ্ঠানগুলি প্রতিবছর ডজনে ডজনে হারিয়ে যায় আর তাদের জায়গা দখল করে গড়ে ওঠে অনুরূপ নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান। তদুপরি, আমার একটি পর্যবেক্ষণের কথা না-বললেই নয় – যে পুঁজি আরও ভালোভাবে অ-সাহিত্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতে পারতো বাজার ভরা অর্থহীন বই বের করে সে পুঁজিকে আটকে রেখে আদর্শবাদিতার ভান করার চেয়ে এমনকি চাহিদার অকপট বাণিজ্যিক তুষ্টি সাধন অনেক বেশী সন্মানজনক যদিও তা ঠিক প্রশংসিত নয়।
কেবলমাত্র অভিজ্ঞতাই জার্মান প্রকাশনা নীতিমালা সম্পর্কিত বাৎসরিক সমালোচনামূলক সমীক্ষার সুবিধা আবিষ্কারে সহায়তা করতে পারে। এই জাতীয় পর্যালোচনা সাহিত্যিক মানদন্ডের চেয়ে সমাজতাত্ত্বিক মানদন্ডকে বেশী গুরুত্ব মনে করে যা গঠনমূলক এবং জৈবিক প্রকাশনা নীতির মধ্যে পারস্পরিক বিরোধকে উন্মোচিত করে। একজন প্রকাশকের কর্মকান্ড নির্দিষ্ট খাতে জড়িয়ে এবং সেই খাত প্রতিষ্ঠার জন্য প্রকাশক তৎপর। তিনি নির্দিষ্ট লেখককুল বা ঘরানার প্রতি আনুগত্যশীল হয়ে তার ব্যবসাকে জৈবিকভাবে বিকশিত করতে পারেন। এই দুটি পথ সবসময় হাত ধরাধরি করে একসাথে নাও এগোতে পারে। এই বাস্তবতা অবশ্যই কোনও প্রকাশককে একটি নির্দিষ্ট ব্যবসায়িক পরিকল্পনা তৈরি করতে এবং নির্দিষ্ট প্রকল্পের সাথে সম্পর্কিত লেখকদের সান্নিধ্যে যেতে সুযোগ করে দিতে পারে। এমন নয় যে, এমন পথটি সম্পূর্ণ অজানা। তবে অর্থনৈতিক উৎপাদন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক উৎপাদন উভয়ের যৌক্তিকীকরণের এ যুগে এটিই প্রথাসিদ্ধ হওয়া উচিত। বর্তমানে এর কোনো লক্ষণ দেখা না-যাওয়ার কারণ হলো প্রকাশকরা তাদের পরামর্শদাতাদের (referees) ভূমিকাকে অবমূল্যায়ন করে যাচ্ছেন। যে সময়ে জুলিয়াস ইলিয়াস বা মরিজ হিইম্যান প্রকাশকের সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপর প্রভাব ফেলতে পারতেন সেই সময় এখন আর নাই। তবে প্রকাশকরা তাদের পরামর্শদাতাদের প্রকাশনার নীতিমালার বিশেষজ্ঞ হিসাবে বিবেচনা না-করে কেবল দ্বাররক্ষী হিসাবে বা বিরুদ্ধপক্ষ হিসাবে বিবেচনা করে বড় ভুল করছেন, এই বিশেষজ্ঞরা অর্থহীন পাণ্ডূলিপি এবং উপভোগ্য পাণ্ডূলিপির পার্থক্য বিচারে যথেষ্ট বুদ্ধি রাখেন। সম্পাদকরা নিজেদের দায়িত্বের অংশ হিসাবে প্রকাশকদের স্বার্থের সাথে নিজেদের ভাবনা-চিন্তাকে সংযুক্ত করা এবং তাদের বৈষয়িক স্বার্থের গুরুত্ব প্রদান করা – এই দুইয়ের মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় ব্যবহার করছেন না, বরং তারা প্রকাশকদের বৈষয়িক অবস্থানের বিপক্ষে নিজস্ব আদর্শবাদের গুরুত্ব স্থাপন করে ভুল করছেন। নেতৃস্থানীয়রা যদি এক এক করে প্রকাশকদের পণ্যগুলির উপর মতামত না-রেখে বা তাদের প্রতি ন্যায়বিচার হচ্ছে না এমন ধারণার জন্ম না-দিয়ে বরং তাদের কর্মকান্ডের সুস্থ সমালোচনা করেন তাহলে সম্মান ও মুনাফায় এই নেতৃস্থানীয়রাই বেশি লাভবান হবেন, এবং তাহলেই সংক্ষিপ্ত এই প্রস্তাবগুলি প্রয়োজনীয় গুরুত্ব বহন করতে সক্ষম।
(১৯৩০ সালের নভেম্বরে Literaturblatt der Frankfurter Zeitung -এ প্রকাশিত। Gesammelte Schriften, দ্বিতীয়, পৃষ্ঠা ৭৬৯ -৭৭২ । ইংরাজি অনুবাদঃ রডনি লিভিংস্টোন।)