১.
নীতিগতভাবে, শিল্পকর্ম সবসময়েই পুনরুৎপাদনযোগ্য। মানুষের তৈরি যে কোনো জিনিসের অনুলিপি আরেকজন মানুষ করতে পারে। যুগ যুগ ধরে শিক্ষার্থীরা তাদের নৈপুণ্য অনুশীলনের জন্য, শিক্ষাগুরুরা তাদের কর্মের বিস্তারের জন্য এবং অবশেষে তৃতীয় আর একটি পক্ষ যারা লাভের জন্য অনুলিপি বা প্রতিলিপি তৈরি করেছে। তবে শিল্পকর্মের প্রযুক্তিগত পুনরুৎপাদন নতুন একটা কিছু। ইতিহাসে বড় বড় ব্যবধানে বিরতি দিয়ে দিয়ে প্রযুক্তিগত পুনরুৎপাদন হাজির হলেও তা এখন দিনে দিনে বাড়তে বাড়তে তীব্র হচ্ছে। প্রযুক্তিগতভাবে শিল্পকর্ম পুনরুৎপাদনে গ্রীকদের ছিল দুটি উপায়ঃ ঢালাই করা এবং মুদ্রাঙ্কন। ব্রোঞ্জ, টেরাকোটা এবং মুদ্রা ছিল একমাত্র শিল্পকর্ম যা তারা প্রচুর সংখ্যায় তারা উৎপাদন করতে পারতো। আর বাকী সবকিছুই ছিল অনন্য এবং প্রযুক্তিগতভাবে পুনরুৎপাদনে অক্ষম। মুদ্রণের মাধ্যমে লিখিত ভাষা পুনরুৎপাদনযোগ্য হয়ে ওঠার বহু আগে কাঠের শিল্পকর্মের মাধ্যমে প্রযুক্তিগতভাবে পুনরুৎপাদনযোগ্য প্রথম শিল্পকর্ম ছিল ছাপচিত্র (graphic art)। মুদ্রণ ব্যবস্থা লেখার প্রযুক্তিগত পুনরুৎপাদনযোগ্যর মাধ্যমে সাহিত্যে যে বিপুল পরিবর্তন এনেছে তা আজ সবার জানা। তবে বিশ্ব ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি এক বিশেষ এবং গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মধ্যযুগে কাঠ খোদাই এবং নকশাচিত্র কাঠের শিল্পকর্মের পরিপূরক ছিল, উনিশ শতকের শুরুতে যেমন লিথোগ্রাফি (পাথর বা ধাতু-ভিত্তিক মুদ্রণ শিল্প)।
লিথোগ্রাফি প্রযুক্তিগত পুনরুৎপাদনের একটি নতুন মৌলিক পর্যায়ে চিহ্নিত করে। কাঠের উপর খোদাই বা তামার প্লেটে অঙ্কনের পরিবর্তে এই নতুন সরাসরি পদ্ধতি ছাপচিত্র শিল্পের শুধুমাত্র বিপুল বাজারই সম্ভব করে তোলেনি প্রতিদিনই এনেছে নতুন নতুন পরিবর্তন। লিথোগ্রাফি ছাপচিত্র শিল্পকে দৈনন্দিন জীবনের চিত্রিত অনুষঙ্গ সরবরাহ করতে সক্ষম করেছে। এটি মুদ্রণ শিল্পের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে শুরু করেছে। তবে লিথোগ্রাফি আবিষ্কারের কয়েক দশক পরে ফটোগ্রাফি ছাপচিত্র শিল্পকে অতিক্রম করে গেছে। প্রথমবারের মত ফটোগ্রাফি ছবি পুনরুৎপাদন প্রক্রিয়াটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শৈল্পিক প্রক্রিয়ার হাত থেকে মুক্ত হয়েছে – যা এখন কেবলমাত্র লেন্সের ভিতর দিয়ে দেখা চোখের উপর নির্ভরশীল। এবং চোখ যেহেতু হাঁতে আঁকার চেয়ে দ্রুত ছবি তুলে আনতে পারে ছবি পুনরুৎপাদন প্রক্রিয়াটি খুবই দ্রুত এগিয়ে গেছে, ফলে তা এখন কথার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে। একজন চিত্রগ্রাহক স্টুডিওতে কোনো দৃশ্য ধারণের সময় অভিনেতার কথার সমান গতিতে চলমান চিত্রগুলি ধারণ করেন। সচিত্র সংবাদপত্রে যেমন ছাপচিত্র শিল্পকর্ম কার্যত লুকিয়ে থাকে, তেমনি ফটোগ্রাফিতে শব্দ লীন হয়ে থাকে। শব্দের প্রযুক্তিগত পুনরুৎপাদনের বিষয়টি গত শতাব্দীর শেষের দিকে মোকাবেলা করতে হয়েছিল। এই অবিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা সম্ভব করে তুলেছিল যে ব্যাপারটি পল ভ্যালারি তাকে বর্ণনা করেছেন এভাবেঃ “যেভাবে ন্যূনতম প্রচেষ্টায় আমাদের চাহিদা মেটাতে দূর থেকে ঘরে ঘরে পানি, গ্যাস এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় তেমনি আমাদের সরবরাহ করা হবে দৃশ্যমান বা শ্রবণের চিত্রগুলি, যা হাতের গতিতে দৃশ্য এবং অদৃশ্য হয়ে যাবে, যা চিহ্নের চেয়ে খুব বেশী কিছু নয়২। ১৯০০ সালের দিকে প্রযুক্তিগত পুনরুৎপাদন এমন একটি মানে পৌঁছে গিয়েছে যে শিল্পকর্মের পরিচিত সমস্ত কিছুকেই তাদের প্রভাবের গভীর পরিবর্তন সাধন করে পুনরুৎপাদনে সম্ভব করে তুলেছে। শুধু তা-ই নয়, শৈল্পিক প্রক্রিয়াগুলির মধ্যে একটি নিজস্ব জায়গাও দখল করে নিয়েছে। শিল্পমান মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শিল্পকর্মের পুনরুৎপাদন এবং চলচ্চিত্র শিল্প এই দুই ভিন্ন প্রকাশ শিল্পের নিজস্ব ঐতিহ্যগত গড়নের উপর কি প্রভাব ফেলছে তা আমরা ভালভাবে অধ্যয়ন করব।
২. পল ভ্যালেরি, Pieces sur l’art ( Paris ), পৃষ্ঠা 105 (“La Conquete de l’ubiquite”). [বেনিয়ামিনের নোট। ইংরাজী অনুদিত Aesthetics বই থেকে, পৃষ্ঠা ২২৬। বেনিয়ামিন Pieces sur l’art এর পরিবর্ধিত তৃতীয় সংস্করণ ব্যবহার করেছেন। জানুয়ারী ১৯৩৬ এ প্রকাশিত। – অনুদিত]